জীবনানন্দ দাশ এর প্রেমের কবিতা Bonolata Sen শঙ্খচিল

 

জীবনানন্দ_দাশ_এর_প্রেমের_কবিতা_Bonolata_Sen_শঙ্খচিল


জীবনানন্দ দাশ 


যেকোন কবির পরিচয় আমরা পেয়ে থাকি তাঁর কাব্য বা কবিতার মধ্যমে । তিনি কে বা তাঁর ব্যাক্তি জীবন পাঠকের কাছে ততধীক গুরুত্ব পায় না । একজন কবিকে জানতে হলে অবশ্যই তাঁর কবিতা পড়তে হবে। রুপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ । "বাংলার রুপ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রুপ খুজিতে যাই না আর।''

এমন কথা যে উচ্চারন করতে পারে তিনিইতো বাংলার একমাত্র প্রকৃতি প্রেমি কবি। তাঁকে আমরা তাঁর বিখ্যাত কবিতা ''বনলতা সেন" এর কবি হিসেবেই বেশি চিনে থাকি।   


জীবনানন্দ দাশ  তাঁর জন্ম ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯ - ২২ অক্টোবর। তিনি ।  ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক৷ তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে একজন। তাঁর কবিতায় পরাবাস্তব  এবং প্রকৃতির অসাধারন মেলবন্ধন মেলে । তাঁর জীবিত কাল তিনি ততধিক প্রসিদ্ধ না হলেও বর্তমান সময়ে  তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবিতে পরিণত হয়েছেন৷


গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা-পুরাণের জগৎ জীবনানন্দের কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররূপময়, তাতে তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ অভিধায় খ্যাত হয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে ‘নির্জনতম কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন৷ অন্যদিকে, অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে ‘শুদ্ধতম কবি’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। সমালোচকদের অনেকে তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি বলেও মনে করেন। 

জীবনানন্দের বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে পুরস্কৃত হয়১৯৫৩ সালে৷ ১৯৫৫ সালে শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থটি ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করে। জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে রূপসী বাংলা, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, বেলা অবেলা কালবেলা, শ্রেষ্ঠ কবিতা ইত্যাদি৷


জীবনানন্দ দাশ প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন৷ তবে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ২২সে অক্টবর তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তিনি ২১টি উপন্যাস এবং ১২৬টি ছোটগল্প রচনা করেছিলেন যার একটিও তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি৷ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে তিনি দিনাতিপাত করেছেন৷ বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে সে সকল  মুদ্রিত হয়েছে৷


জীবনানন্দ দাশ প্রেমের কবিতা 

 তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে। এর দীর্ঘ কাল পর ১৯৩৬-এ প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ধূসর পান্ডূলিপি।   


আমাকে তুমি


আমাকে তুমি দেখিয়েছিলে একদিন:

মস্ত বড়ো ময়দান— দেবদারু পামের নিবিড় মাথা— মাইলের পর মাইল;

দুপুরবেলার জনবিরল গভীর বাতাস

দূর শূন্যে চিলের পাটকিলে ডানার ভিতর অস্পষ্ট হ’য়ে হারিয়ে যায়;

জোয়ারের মতো ফিরে আসে আবার;

জানালায়-জানালায় অনেকক্ষণ ধ’রে কথা বলে:

পৃথিবীকে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয়।

তারপর

দূরে

অনেক দূরে

খররৌদ্রে পা ছড়িয়ে বর্ষীয়সী রূপসীর মতো ধান ভানে— গান গায়— গান গায়

এই দুপুরের বাতাস।


এক-একটা দুপুরে এক-একটা পরিপূর্ণ জীবন অতিবাহিত হ’য়ে যায় যেন।


বিকেলে নরম মুহূর্ত;

নদীর জলের ভিতর শম্বর, নীলগাই, হরিণের ছায়ার আসা-যাওয়া;

একটা ধবল চিতল-হরিণীর ছায়া

আতার ধূসর ক্ষীরে-গড়া মূর্তির মতো

নদীর জলে

সমস্ত বিকেলবেলা ধ’রে

স্থির।


মাঝে-মাঝে অনেক দূর থেকে শ্মশানের চন্দনকাঠের চিতার গন্ধ,

আগুনের— ঘিয়ের ঘ্রাণ;

বিকেলে

অসম্ভব বিষণ্ণতা।

ঝাউ হরিতকী শাল, নিভন্ত সূর্যে

পিয়াশাল পিয়াল আমলকী দেবদারু—

বাতাসের বুকে স্পৃহা, উৎসাহ, জীবনের ফেনা;


শাদা শাদাছিট কালো পায়রার ওড়াউড়ি জ্যোৎস্নায়— ছায়ায়,

রাত্রি;

নক্ষত্র ও নক্ষত্রের

অতীত নিস্তব্ধতা।


মরণের পরপারে বড়ো অন্ধকার

এই সব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো।



জীবনানন্দ দাশ প্রেমের কবিতা বনলাতা সেন 


তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ বনলতা সেন প্রকাশিত হয় ১৯৪২-এ। এটি "কবিতাভবন সংস্করণ" নামে অভিহিত। 

সিগনেট প্রেস বনলতা সেন প্রকাশ করে ১৯৫২-তে।


বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের কবিতাসমূহ সহ পরবর্তী কবিতাগ্রন্থ মহাপৃথিবী ১৯৪৪-এ প্রকাশিত। জীবনানন্দর 

জীবদ্দশায় সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮)। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর কিছু আগে 

প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা।

বনলাতা সেন

হাজার বছর ধরে
আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে
নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে, 
অনেক ঘুরেছি আমি
বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে,
সেখানে ছিলাম আমি
আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে,
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক
চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো
নাটোরের বনলতা সেন।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য,
অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা,
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে
দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে
বলেছে সে, এতদিন কোথায় ছিলেন?
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে
নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে
শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে
ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল,
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে 
পাণ্ডলিপি করে আয়োজন,
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল

জীবনানন্দ দাশের কবিতা শঙ্খচিল


সোনালি ডানার শঙ্খচিল

জীবনানন্দ দাশ


 মনে পড়ে সেই কলকাতা–সেই তেরোশো তিরিশ–

বস্তির মতো ঘর,

বৌবাজারের মোড়ে দিনমান

ট্রাম করে ঘরঘর।

আমাদের কিছু ছিল না তখন

ছিল শুধু যৌবন,

সাগরের মতো বেগুনি আকাশে

সোনালি চিলের মন।


ছেঁড়া শাড়ি পরে কাটাইতে দিন

বাঁটনা হলুদ মাখা

বিভারানী বোস, তোমার দু হাতে

ছিল দুটো শাদা শাঁখা,

শাদা শাঁখা শুধু তোমার দু হাতে

জুটিত না তেল চুলে,

তবুও আমরা দিতাম আকাশে

বকের পাখনা তুলে। 


জুটিত না কালি কলমে আমার

কাগজে পড়িত টান,

তোমার বইয়ের মার্জিনে, বিভা,

লিখিতাম আমি গান।

পাশের বাড়ির পোড়া কাঠ এনে

দেয়ালে আঁকিতে ছবি।

আমি বলিতাম–’অবন্তী-বিভা’,

তুমি শুধাইতে ‘ঈগল কবি’


চক্ষে তোমার মিঙ্ যুগ ভাসে

কাঙড়ার ছবি ঐ নীল চোখে

আমার হৃদয়ে অনুরাধাপুর

পুরানো ফরাসি গানের বোকে

সেদিন আমার পথে পথে হাঁটা

সেও তম্বুরা মান্ডলিন

তোমার সেদিন ঘর সিঁড়ি ভাঙা

বাংলার পট, পুরোনো চীন। 


পৃথিবীর মুখে তুড়ি দিয়ে দিয়ে

দুইটি হৃদয় সেই

ডাল তেল নুন জোটে না যাদের

জামা-শাড়ি কিছু নেই,

তবুও আকাশ জয়ের বাসনা

দু:খের গুলি সে যেন ঢিল,

আমরা দুজনে বেগুনি আকাশে

সোনালি ডানার শঙ্খচিল—




শরীরের ক্ষুধা মাটির মতন

স্বপ্ন তখন সোনার সিঁড়ি,

মানুষ থাকুক সংসারে পড়ে

আমরা উড়িব পৃথিবী ছিঁড়ি।


সকাল হয়েছে: চাল নাই ঘরে,

সন্ধা হয়েছে: প্রদীপ নাই,

আমার কবিতা কেউ কেনে নাকো?

তোমার ছবিও ঘুঁটের ছাই? 




ছ মাসের ভাড়া পড়ে আছে না কি?

ঘরে নাই তবু চাল কড়ি নুন?

আকাশের নীল পথে পথে তবু

আমার হৃদয় আত্তিলা হূণ

আকাশের নীল পথ থেকে পথে

জানালার পর জানালা খুলে

ভোরের মুনিয়াপাখির মতন

কোথায় যে দিতে পাখনা তুলে।


সংসার আজ শিকার করেছে

সোনালি চিলেরা হল শিকার,

আজ আমি আর কবিতা লিখি না

তুমিও তো ছবি আঁকো না আর।

তবুও শীতের শেষে ফাল্গুনে

মাতাল যখন সোনালি বন

তেরোশো তিরিশ—দারিদ্র্য সেই

ফিরে চাই আজ সে যৌবন। 


ফিরে চাই আমি তোমারে আবার

আমার কবিতা, তোমার ছবি—

শুধাতাম আমি ‘অনুরাধাপুর’—

শুধাইতে তুমি ‘শকুন কবি’।

সেই-যে আকাশ খোঁজার স্বপ্ন


দুখের ছররা—সে যেন ঢিল,

আমরা দুজনে বেগুনি আকাশে

সোনালি ডানার শঙ্খচিল। 


জীবনানন্দের কষ্টের কবিতা


সূর্যতামসী


জীবনানন্দ দাশ


কোথাও পাখির শব্দ শুনি;

কোনো দিকে সমুদ্রের সুর;

কোথাও ভোরের বেলা র'য়ে গেছে - তবে।

অগণন মানুষের মৃত্যু হ'লে - অন্ধকারে জীবিত ও মৃতের হৃদয়

বিস্মিতের মতো চেয়ে আছে;

এ কোন সিন্ধুর সুর:

মরণের - জীবনের?

এ কি ভোর?

অনন্ত রাত্রির মতো মনে হয় তবু।

একটি রাত্রির ব্যথা সয়ে -

সময় কি অবশেষে এ-রকম ভোরবেলা হয়ে

আগামী রাতের কালপুরুষের শস্য বুকে ক'রে জেগে ওঠে?

কোথাও ডানার শব্দ শুনি;

কোন দিকে সমুদ্রের সুর -

দক্ষিণের দিকে,

উত্তরের দিকে,

পশ্চিমের পানে?


সৃজনের ভয়াবহ মানে;

তবু জীবনের বসন্তের মতন কল্যাণে

সূর্যালোকিত সব সিন্ধু-পাখিদের শব্দ শুনি;

ভোরের বদলে তবু সেইখানে রাত্রি করোজ্জ্বল

ভিয়েনা, টোকিও, রোম, মিউনিখ - তুমি?

সার্থবাহ, সার্থবাহ, ওইদিকে নীল

সমুদ্রের পরিবর্তে আটলাণ্টিক চার্টার নিখিল মরুভূমি!

বিলীন হয় না মায়ামৃগ - নিত্য দিকদর্শিন;

যা জেনেছে - যা শেখেনি -

সেই মহাশ্মশানের গর্ভাঙ্কে ধূপের মত জ্ব'লে

জাগে না কি হে জীবন - হে সাগর -

শকুন্ত-ক্রান্তির কলরোলে।


কবিতাটি ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ "সাতটি তারার তিমির থেকে নেওয়া হয়েছে।" 



জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতা

আবার আসিব ফিরে  

আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়

হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শংখচিল গাঙ-শালিখের বেশে,

হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে

কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।

হয়তো বা হাঁস হব- কিশোরীর- ঘুঙুর রহিবে লাল পায়

সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে।

আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে

জলঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এই সবুজ করুণ ডাঙ্গায়।


হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে।

হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমূলের ডালে।

হয়তো খইয়ের ধান ছড়াইতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে।

রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে

ডিঙ্গা বায়; রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে

দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।

 

এ গুলিও পড়ুন


Previous
Next Post »

এই ব্লগটি সন্ধান করুন