মন ভাঙনের পাড়ে
শক্তি সামন্ত
আধুনিক প্রেমের উপন্যাস মন ভাঙনের পাড়ে ভাগ 15
[পনের ]
শেষ অংশ
উজান এখন ফ্যামিলি নিয়ে দিল্লিতে থাকে।ভালই আছে ওরা । মাঝে মধ্যে খবর পায় রূপক।
উজানের এক ছেলে বছর খানেকের হবে।রূপক জানতই না উজানের বিয়েটা কিভাবে হয়েছে।
শুধু রূপক কেন পাড়ার অনেকেই সঠিক ভাবে জানত না। পরে পরে জেনেছে।
তার বিয়েটাই হয়েছিল অদ্ভুত ভাবে।অনেক চাপানউতোর।অনেক টেনশনের মধ্যে দিয়ে।উজানের
বৌদি রাগে তিন দিন না খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। রন্টি, সোম, বিতান
আর রূপক গিয়ে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বৌদিকে মানিয়ে ছিল।
তখনও রূপকের বিয়ে হয়নি।দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার কারন রূপক অনেক কিছুই জানত না।
উজান তার প্রিয় বন্ধু হয়েও কেন তার থেকে এত কথা লুকিয়ে রাখে কে জানে! জানবার
পর জিজ্ঞেস করলে বলে, "তোকে বলব বলব করে আর বলা হয়ে উঠেনি।" ক্ষণিকের অভিমান
জল হয়ে যায় তার।প্রতিবারের মতো সেবারও দেশে ফিরে রূপক একরাশ খুশি নিয়ে।ট্রেন জার্নির
গ্লানি কাটিয়ে প্রায় সন্ধ্যের সময় ঘুম থেকে উঠে ক্লাবের দিকে যাচ্ছিল।
[আধুনিক প্রেমের উপন্যাস মন ভাঙনের পাড়ে ভাগ 15]
বট তলায় ওরা ক-জন
আড্ডা দিচ্ছে। রূপককে দেখে খুশিতে আমোদিত সোম,রন্টি, পটলা। রূপক বসে পড়েছিল তাদের
মাঝে।অনেক কথা হাসি ফুর্তি ইয়ার্কি মাঝে উজানের কথা জিজ্ঞেস করতেই
শু্নেছিল এক অভিনব কাহিনী।তার টেলার্সের ব্যাবসাটা চলছিল না ঠিক মতো।ব্যাবসাটা বন্ধ করে
দিয়ে তার বড়দার শালার কাছে কাজ করতে শুরু করে।
মাস-মাইনে ভালই
পেত। তারই মধ্যে একটা ঝামেলা বাঁধে । ওখানকার কিছু গুণ্ডা টাইপের ছেলে উজানদের কে ভয়
দেখায় বড় বড় ছুঁড়ি,বন্দুক দেখিয়ে শাসিয়েছে। কারন ঐ গুণ্ডাদের মধ্যে কোন
একজন নাকি উজানের বৌদির ছোট বোন সুমিতাকে ভালবাসত কিন্তু সুমিতা তার মুখের উপর
না বলে দিয়েছিল। আর যেহেতু সুমিতা উজান দের সাথে আত্মীয়তার সূত্রে
কথা বলে বা মেলা মেশা করে সেটাই ওদের রাগের কারন।
বিশেষ করে উজানের উপর।সুমিতা
যেহেতু না বলে দিয়েছে তাই মার্ডার করে দেবে বলেও হুমকি দিয়েছে। তাই
উজান সুমিতাকে নিয়ে চলে এসেছে। রূপক বিষয়টা বেশি ভাবনা চিন্তা না করেই উজানকে
আইডিয়া দিয়েছিল 'এক কাজ কর তোর মেজদার সাথে বিয়ে দিয়ে দে।ল্যাঠা চুকে
যাক।'উজান মুচকি হেসে বলেছিল ,"তুই বলে দেখ দাদাকে রাজি হয় কি না।" উজানের মুচকি
হাসির রহস্য পরদিন বুঝতে পেরেছিল।
[আধুনিক প্রেমের উপন্যাস মন ভাঙনের পাড়ে ভাগ 15]
পরদিন গণেশ দার চায়ের দোকানে এই একই বিষয়ে আলোচনা চলছিল। রূপক আবার একই
কথা বলতেই পটলা হেসে উঠেছিল।রূপক পটলার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে
হাসির কারন জিজ্ঞেস করতেই জানতে পেরেছিল।'উজান সুমিতাকে ভালবাসে এবং বিয়ে করতে
চায়।' রূপক নিজের বেওকুফি বুঝতে পেরে লজ্জ্বিত হয়ে উজানের দিকে জিজ্ঞাসু
দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। সারার সাথে কি তাহলে......
সুমিতা আর তার বাড়ি ফিরে যেতে চায় না।উজানের সাথেই থকবে সে। সুমিতার বাবা
ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সুমিতা ফিরিয়ে দিয়েছে তাকে। কিন্তু এই ভাবেতো আর থাকা
যায় না সমাজ বলেওতো একটা ব্যাপার আছে।ইতিমধ্যে পাড়া পড়শি সকলেই জেনে গেছে তাদের
বিষয়ে।উজান আর এইভাবে বেশি দিন বসে থাকলে চলে না । কিছু একটা কাজ তাকে করতে হবে ।
দিল্লিতে একটা কাজ ঠিক হল এবং সে চলে যাবে ।কিন্তু সুমিতার কি হবে? বিয়েতো তাকে
করেনি তার নিজের দিদিও তাকে এইভাবে রাখবে না পাড়ার লোক দুটো কথা
শুনাবে ভাল লাগবে না মোটেই ।কি করবে না করবে ভেবে ভেবে একটা কাজ করল। যে
দিন তার দিল্লির টিকিট ছিল।ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময়।
[আধুনিক প্রেমের উপন্যাস মন ভাঙনের পাড়ে ভাগ 15]
সুমিতা তাকে
এগিয়ে দিতে এসেছিল। বাড়ির সামনেই যে মন্দিরে প্রণাম করতে এসেছিল সেখানেই মন্দিরের
সিন্দূর সুমিতার মাথায় লাগিয়ে স্ত্রীর পরিচয় দিয়ে ছিল।তারপর থেকে তারা স্বামি স্ত্রি।
সুখেই আছে এখন।
কখনও কখনও মানুষের জীবনে এমন টাইম আসে যা আগে থেকেই টের পাওয়া যায়। উজানও
আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল সারাকে সে কোন দিনও পাবে না।
বহু চেষ্টা করেছিল সারাকে ধরে রাখতে কিন্তু না সে পারেনি।রিঙ্কির বিয়ে ছিল সেদিন স্বভাবতই
উজানেরও নিমন্ত্রণ থাকার কথা।আলোর শামিয়ানায় ভরে উঠেছে চারিদিক
উজান অধির হয়ে খুঁজছিল সারা কে। একটু তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেছিল সে।আলোর প্যান্ডেল ছেড়ে
একটু দূরে নিতু বৌদিদের ঘরের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছিল।
সারা এল হাসি মুখে । দুজনে একটু আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায়। সারা সেদিন দারুণ সেজেছিল। দেখে
খুব ভালো লাগছিল উজানের ।যেন রূপকথার পরি। সব প্রেমিকাকেই তার
প্রেমিকের কাছে পরি মনে হয়। না হলে তো প্রেম হয় না । এমন সময় কোথা থেকে সারার ভাই
অনিক আসছিল এদিকেই। সারা ভয় পেয়ে বলে উঠেছিল, "এই রে ভাই আসছে এক্ষুনি
মাকে গিয়ে বলে দেবে।
[আধুনিক প্রেমের উপন্যাস মন ভাঙনের পাড়ে ভাগ 15]
কেলেঙ্কারির শেষ থাকবে না।" তারা একটা নারকেল গাছের আড়ালে গিয়ে
লুকোয়।দেখতে পেয়েছিল বোধহয়! সামনেই নিতু বৌদিদের একটা পরিত্যক্ত
ঘর রয়েছে তাতে যত রাজ্যের অব্যবহৃত জিনিসপত্র পড়ে থাকে।প্রায় সময় খোলায় থাকে ঘরটা।
ওরা ভিতরে ঢুকে গিয়ে ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছিল।
অনিকের কি
সন্দেহ হয়েছিল? কে জানে দেবার সাথে কথা বলতে বলতে সেখানে এসে হাজির একেবারে ওই
ঘরটার দরজার সামনেই। উজান আর সারা বন্দি হয়ে ছিল ।কতক্ষণ তার
কোন হিসেব নেই।মুখে কোন কথাও বলা যাবে না।তারা কি অস্বস্তিতে পড়ল? মোটেই না।
সারা একটু উজানের গা ঘেঁসে এসে দাঁড়ালে উজান একটু নড়ে চড়ে উঠেছিল ।
তারপর
বুকে বুক ঠেকে গেল ঠোঁটে ঠোঁট ।কথা বলা তাদের বারন। তাহলেই বিপদের সম্ভাবনা ।
সারা ভাবছে ওরা এখান থেকে সরছে না কেন ? উজান ভাবছে দাঁড়িয়ে
থাকুক আরও কিছুক্ষণ।তবুও বুকের ভিতর একটা ভয় লুকিয়ে ছিল। অনিক জানতে পারলেই
বিপদ।পরের দিন থেকেই সারার উপর শুরু হল নজরদারি।যেটা সন্দেহ করেছিল সে ঠিক সেটাই
হয়েছিল।অনিক বাড়িতে এসে সব বলে দিয়েছিল।
সে উজানের সাথে কোথাও লুকিয়ে
পড়েছিল কিন্তু কোথায় লুকিয়েছিল সেটা বুঝতে পারেনি। শুরু হল সাওয়াল জবাব। অনেকদিন
ধরেই কানাঘুষো অনেক কিছুই শুনছে সারার মা।প্রমান ছিল না বলেই কিছু
বলতে পারেনি। কিন্তু সেদিন আর লুকিয়ে রাখতে পারেনি। স্বীকার করে নিয়েছিল যে সে উজানকে
ভালবাসে।তারপর শুরু হল ব্রেন ওয়াশ।
তারপরও একদিন কোন কারন বশত দেখা হয়েছিল নদীর পাড়ে।
উজান অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছিল সারাকে কিন্তু
ফ্যামিলির চাপে সারার কিছু করার নেই।উজান শুধু অভিমান ভরা গলায় বলেছিল , "সারা তুমি না
বলেছিলে..." আর কিছুই বলে উঠতে পারেনি ।গলার কাছে অজস্র কান্না দলা পাকাচ্ছে।উজান ভাবতে
থাকে সব কিছুই নিষ্ঠুর নিয়তির হাতে। সেখান থেকে কেউই নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারে না।
সারা চলে গেল। এখন আর তার সাথে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক নয়। উজান একাই দাঁড়িয়ে ছিল নদীর
ধারে জোয়ারে পাড় ভেঙ্গে পড়ছিল আর তার বুকটাও ভেঙ্গে চূরচূর হয়ে যাচ্ছিল ।
তার মনে পড়ে যাচ্ছিল সেদিনকার সেই ঘটনা।ডোরার কোন এক বান্ধবীর বিয়ে ছিল ওরা কয়েক
জন মিলে সেজে গুজে উজানের কারখানায় এসে হাজির। ডোরা বলেছিল, "বিয়ে
বাড়ি যাব।"তখন রাত্রি আটটা ন-টা বাজে প্রায়।
[আধুনিক প্রেমের উপন্যাস মন ভাঙনের পাড়ে ভাগ 15]
সারা জোর গলায় বলেছিল, "এটা আমার
কারখানা।"উজান মনে মনে কতই না খুশি হয়ে ছিল সেদিন। যাক সারা যে তার উপর
অধিকার রাখে সেটা ভাল না বাসলে এমন অনুভব হয় না কারও। ডোরা হাসতে হাসতে
বলেছিল "বাব্বা!" "এখন থেকেই এত জোর।" সারা আরও বলেছিল , "যেটা আমার
সেটা আমার বলতে দোষ কোথায়?'' সবাই চুপ করে গেছিল তার কথা শুনে।শুধু উজান
মুচকি মুচকি হাসছিল।আজ সব কিছুই ভুলে গেছে সারা।
নাকি ভুলে যাওয়ার
ভান করছে। সারার বিয়ে হয়েছিল এক সরকারি চাকুরের সাথে।সারার অপছন্দ
থাকা সত্ত্বেও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। উজান খুব চেষ্টা করেছিল সারাকে ভুলে যেতে।
যেদিন সারা কণকাঞ্জলি দিয়ে বিদায় নিল। ডোরার মনটাও ডুকরে উঠেছিল সেদিন।
কাঁদতে কাঁদতে সারা ,ডোরাকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছিল,
"উজানকে বলিস ক্ষমা করে দিতে।"
ডোরাদের ছাদেও এখন আর কেউ আসে না। অন্যত্র চলে গেছে ডোরারা।বিদেশি ফুলের গাছ
গুলোও শুকিয়ে গেছে। কয়েকটা গাছে এখনও অযত্নে ফুল ফুটছে। আর পায়রা গুলো
কবেই উড়ে গেছে। একরাশ শূন্য বুকে শ্যাওলা জন্মাচ্ছে ডোরাদের ফুটবল মাঠের মতো বড় ছাদে।
[ সমাপ্ত ]
*****************
[সমাপ্ত]
ConversionConversion EmoticonEmoticon