ধারাবাহিক উপন্যাস ১৯ শ কিস্তি
ভুল স্টেশনে নেমে
সমীরণ সরকার
পলাশ এমনিতে খুব একটা ভীতু নয়। কিন্তু এই গভীর নিশীথে সম্পূর্ণ অজানা অচেনা জঙ্গলে ঢুকতে গিয়ে তার বুকের ভিতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠলো। আজই কি তবে তার জীবনের শেষ রাত্রি? আর কি সে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে না? আর কি দেখতে পাবে না কাউকে-- বাবাকে মাকে ছোট্ট বোনটাকে? কিন্তু....!
না, জীবনে সফলতা বলতে যা সবাই বোঝে, তা এখনো করায়ত্ত হয়নি তার। অর্থনৈতিক সাফল্য তার জীবনে এখনো আসেনি। নিতান্তই সাদামাটা ভাবে কেটে যাচ্ছে তার জীবন। বাড়িতে অসুস্থ বাবা, অবিবাহিতা বোন-- কারোর প্রতি সেভাবে কোন কর্তব্য পালন করতে পারেনি সে।
আর মা? সংসারের ঘানি টানতে উদয়াস্ত ব্যস্ত একজন কর্তব্যপরায়ণ মহিলা। ফর্সা, রোগা, প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামে লড়াই করতে করতে ক্ষয়ে যাওয়া একজন বাঙালি বধূ । তবুও অনেক স্বপ্ন দেখতো মা । স্বপ্নগুলো মাঝে মাঝে শেয়ার করত পলাশের সঙ্গে ।
টিউশনি করে ফিরে আসার পর দুপুর বেলায় যখন তাকে খেতে দিত , তখন প্রায়ই অনেক কথা বলতো মা-- অনেক ইচ্ছার কথা, অনেক স্বপ্নের কথা। একটা ধুলোমাখা বিবর্ণ ডাঁটভাঙ্গা
তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে কথা বলতো মা। খাওয়ার থালার চারিদিকে ভন ভন করত মাছি। মা ভাঙ্গা পাখা দিয়ে সেগুলো তাড়াবার চেষ্টা করত আর ফাঁকে ফাঁকে কথা বলে যেত। পাখা নাড়ানোর তালে তালে মায়ের রোগা হাতে ক্ষয়ে যাওয়া ময়লা শাঁখা আর ফ্যাকাশে লাল পলা ঢলঢল করত। পলাশ খেতে খেতে চুপচাপ মায়ের কথা শুনে যেত। মা রেগে গিয়ে বলতো, "কিরে, আমি একাই বকবক করে যাচ্ছি,তুই তো কিছুই বলছিস না!"
----- আমি শুনছি তো।
----- হ্যাঁ, শুনছিস, কিন্তু কিছু বলছিস না কেন?
----- তুমি তো দেখছ মা যে,আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিন্তু....
----- কিসের কিন্তু? লড়াই করতে নেমে সেনাপতির মনে কোন কিন্তু থাকতে নেই, সৈন্যরা তাহলে মনোবল হারিয়ে ফেলে।
------ মানে?
------- তোর বাবা শয্যাশায়ী, সুমিতা এখনো খুব ছোট আর আমি তো সংসারের বাইরে কিছুই বুঝিনা। কাজেই আমরা সবাই তোর মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে আছি। প্রতি মুহূর্তে আমরা যে লড়াই করছি তা তো পুরোপুরি তোর উপরে ভরসা করেই।
------ আমি তো সাধ্যাতীত চেষ্টা করছি মা,তবু তো এখনো.....
----- সৎ পথে থেকে নিজের লক্ষ্য স্থির করে লড়াইটা চালিয়ে যা বাবা।আমি বলছি, তুই একদিন জিতবিই জিতবি। একটা কথা তোকে বলি বাবা।
-------কি?
--------- প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার নামই জীবন। আর যে কোনো লড়াইয়ে মনের জোরটাই আসল শক্তি। কোনদিন কোন অবস্থাতেই মনের জোরটা হারাবি না ।
পলাশ মনে মনে একবার মায়ের মুখটা কল্পনা করে ,তারপর বিড়বিড় করে বলে,না, আমি হারবো না মা।
নন্দিনী বলে, কিছু বললে পলাশদা?
---- নারে ,কিছু না। চল ,এগোই আমরা।
----- হ্যাঁ ,চলো। ছোটবেলায় আমরা 'সরকার পুকুরের' পাড়ে বিকেলবেলায় কানামাছি খেলতাম মনে আছে তোমার?
----- হ্যাঁ, মনে আছে । কিন্তু এখন সে কথা বলছিস কেন বলতো?
------ আমরা যারা চোখ খোলা অবস্থায় ঘুরে বেড়াতাম, তারা তো ইচ্ছে খুশি এদিক-ওদিক করতাম। কিন্তু যার চোখ বাঁধা থাকতো, সে কি করত বলতো?
----কি?
------- চোখ বাঁধা থাকত বলে কিছুই দেখতে পেত না। তাই সে দুই হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে খুঁজে বেড়াতো তার খেলার সাথীদের। আমরাও জঙ্গলের ভিতরে কতকটা সেইভাবে ধীরে ধীরে এগোবো।
----- মানে?
------ আমরা ঐভাবে এগুলে কোন গাছ বা গাছের ডালে ধাক্কা খাব না। কিছুক্ষণ চলার পরে যখন চোখে সয়ে যাবে অন্ধকার, তখন সহজেই সব দেখতে পাবে।
নন্দিনীর কথা শেষ হতে না হতেই হঠাৎ পলাশের মনে হল তার পায়ের উপরে যেন কোন শীতল স্পর্শ অনুভব করছে। তবে কি কোন সরীসৃপ প্রাণী তার পায়ের উপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে?
পলাশ নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
(চলবে)
ConversionConversion EmoticonEmoticon