ধারাবাহিক উপন্যাস
ভুল স্টেশনে নেমে
নবম কিস্তি
সমীরণ সরকার
মাটিতে বসে পড়েছে নন্দিনী। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। পলাশ ওর কাছে পৌঁছে নিচু হয়ে বসে ক্ষতস্থানটা বিদ্যুতের আলোয়
ভালোভাবে পরীক্ষা করে বুঝতে পারলো যে, নন্দিনীকে বিষধর সাপে দংশন করেছে। মুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল পলাশ।
পলাশকে দু'হাতে ধরে নন্দিনী ডুকরে উঠলো, আমি আর বাঁচবো নারে পলাশদা, আমি আর বাঁচবো না। নন্দিনীর আর্ত কণ্ঠস্বর পলাশের কানে পৌঁছাতেই সে যেন সম্বিত ফিরে পেল। চিৎকার করে উঠল পলাশ, কে বলেছে বাঁচবি না তুই? আমি তোকে মরতে দেব না।
মুহূর্তেই নিজের কর্তব্য ঠিক করে ফেলল পলাশ। পকেট থেকে রুমাল বের করে নন্দিনীর ক্ষতস্থান টা ভালো করে বেঁধে দেয়। তারপর নিকটবর্তী হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরি হয় মনে মনে। নিকটবর্তী হাসপাতাল বলতে বাসুদেবপুর গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র।
এখান থেকে বাসুদেবপুর হাসপাতাল প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। তবু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নন্দিনীকে ওই হাসপাতালে নিয়ে যেতেই হবে চিকিৎসার জন্য। কিন্তু কিভাবে? এখন গ্রামে ফিরে গিয়ে কোন যানবাহনের ব্যবস্থা করে নন্দিনীকে হাসপাতালে নিতে হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাছাড়া নন্দিনীকে এখানে একলা ফেলে রেখে সে গ্রামে ফিরে যাবে কি করে? তাহলে কি করবে সে? কি করবে?
একটা ,হ্যাঁ ,একটাই মাত্র উপায় আছে। আর সেটাই করতে হবে পলাশকে। মুহূর্তে নিজের কর্তব্য ঠিক করে নেয় সে।
সে শুনেছে যে, সাপে কাটা রোগীকে ঘুমতে দিতে নেই। যেমন করে হোক জাগিয়ে রাখতে হবে তাকে। তাই সে নন্দিনীর কাছে গিয়ে বলল, শোন নন্দিনী, তোকে এক্ষুনি বাসুদেবপুর হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
--- কিন্তু কি করে? এখন এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে ভ্যান - রিকশা কিছুই তো পাওয়া যাবে না।
--- ওই ভাবনাটা তুই আমার উপরে ছেড়ে দে। তোকে শুধু একটা কথা মনে রাখতে হবে।
------ কি?
------- তোকে জেগে থাকতে হবে।
------ মানে?
------- ঘুম পেলেও কিছুতেই ঘুমাবি না তুই।
এরপর পলাশ নিজের গায়ের জামাটা খুলে নন্দিনীর মাথা ভালো করে ঢেকে দেয়। তারপর পাঁজাকোলা করে নন্দিনীকে তুলে নেয় বলিষ্ঠ দুই হাতে। তারপর ছুটতে শুরু করে।
বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি, ঝোড়ো হাওয়া আর মাঝে মাঝেই বজ্রপাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে পলাশ, কর্তব্যে অবিচল এক দৌড়বিদ।
কিছুক্ষণ ছোটার পরে পলাশের দুই হাতে ধরা নন্দিনীর দেহ মনে হল যেন অসম্ভব ভারী হয়ে গেছে। সে আর বোঝা হাতে পারছে না ছুটতে।
কিন্তু তাকে তো ছুটতে হবেই। বাঁচাতে হবে তো মেয়েটাকে। এবারে নন্দিনীকে কাঁধের উপরে ফেলে দাঁতে দাঁত চেপে ছুটতে শুরু করে পলাশ। অতীতে দেবাদিদেব মহাদেব মৃত সতীর দেহ কাঁধে করে তান্ডব নৃত্য শুরু করেছিলেন নিজের ক্ষোভ ও দুঃখের
বাসুদেবপুর হাসপাতালে যখন পলাশ পৌঁছালো তখন হাসপাতালের একমাত্র ডাক্তার বাবু মনোজ সেন ডিউটি শেষ করে চলে গেছেন তার বাড়িতে, পাশের গ্রাম মনোহরপুরে। একজন নার্স আর চতুর্থ শ্রেণীর জনা দুয়েক কর্মচারী ছাড়া হাসপাতলে কেউ ছিলনা। ওদের উপরে নন্দিনীর দায়িত্ব দিয়ে আবার দৌড় শুরু করে পলাশ।
ভালো ফুটবল খেলোয়াড় হওয়ার সুবাদে পলাশকে বিশেষভাবে চিনতেন ডাক্তার মনোজ সেন। তাই এক মুহূর্ত দেরি না করে নিজের মোটর বাইকের পিছনে পলাশ কে বসিয়ে হাসপাতালে পৌঁছালেন।
দ্রুত চিকিৎসা শুরু হয়েছিল।
বাসুদেবপুর হাসপাতালে এন্টিভেনম এর স্টক সাফিশিয়েন্ট ছিলনা। সাব -ডিভিশনাল হসপিটালে রিকুইজিশন পাঠিয়েছিলেন ডাক্তার মনোজ সেন। হাসপাতালের একজন কর্মীকে মোটর বাইকের পিছনে বসিয়ে গেঞ্জি গায়ে আবার ছুটেছিল পলাশ ।
সারারাত ধরে মেয়েটাকে বাঁচাবার জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করলেন ডাক্তার সেন। ভোরের দিকে চোখ মেলল নন্দিনী ।
নতুন জীবন ফিরে পেল মেয়েটা।
পলাশ আর নন্দিনীর এতদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ঘুচে গিয়ে শুরু হলো এক নতুন সম্পর্কের যাত্রা। অনন্ত ভালোলাগায় মশগুল হয়ে উঠল দুজনে। প্রথমটায় ব্যাপারটা দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ বন্ধু মহলেও ব্যাপারটা জানাজানি হয়। খুশি হয় সবাই, শুধু একজন ছাড়া।
(চলবে)
ConversionConversion EmoticonEmoticon