প্রবন্ধ কবিতার শৈলী কলমে সৌম্য ঘোষ

 

 
প্রবন্ধ_কবিতার_শৈলী_কলমে_সৌম্য_ঘোষ

 প্রবন্ধ         

কবিতার শৈলী :          

                                     

                সৌম্য ঘোষ

                    
 কবিতা হল শব্দময় কথা । শুধু কবিতা কেন যেকোনো সাহিত্যই হল শব্দের শিল্প। মনের সংসারে যে  ভাবের আবেগ জন্ম নেয় , সেই ভাবটিকে ভাষায় প্রকাশ করাই হল সাহিত্য । রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'নীরব কবিত্ব' ও 'আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাস'  দুটোই হলো সাহিত্যের বাজে কথা । কবিত্ব তথা সাহিত্যের অন্যতম শর্ত হলো প্রকাশিত হওয়া । সাহিত্যে প্রকাশ ও দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বাক্যে প্রকাশ কখনোই এক নয় । কবি-সাহিত্যিকদের সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষাই সাহিত্য কে   সৌন্দর্যে ভরিয়ে তোলে নান্দনিক স্থায়িত্বে। এর জন্য নানা কলা ও শৈলীর আশ্রয় নিতে হয় । তাই রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে জীবনানন্দের কবিতা কিংবা শরৎচন্দ্রের উপন্যাস থেকে কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাসকে আলাদা করে চিনে নেওয়া বিশেষ কষ্টসাধ্য হয় না।
এঁরা এঁদের সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে নিজের নিজের ব্যক্তিত্বকে চিরন্তন করে তুলেছেন । সাহিত্যে এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এর ধারণা থেকে শৈলী বিজ্ঞান চর্চার পথ সুগম হয়। বুঁফো বলেন, " style is the man himself ."

                        সংস্কৃত আলংকারিকগণ শৈলী নিয়ে চর্চা করলেও তাঁরা "শৈলী" শব্দ ব্যবহার না করে " রীতিবাদ" রূপে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের মতে  , কাব্যের আত্মা হলো -- রীতি।  "রীতিরাত্মা কাব্যস্য" ।  তাঁরা অলংকার এর চেয়েও কাব্যের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে গুনের কথা বলেন ‌।  গুন অর্থাৎ বর্ণনাভঙ্গির সৌকর্য সঞ্জাত বাক্ ভঙ্গি । তাঁরা দশটি গুণের কথা উল্লেখ করেন, যাদের বলা হয় "মার্গ" । এই মার্গ গুলি হল ---  শ্লেষ, প্রসাদ, সমতা, সমাধি, মাধুর্য, ওজ: , পদ সৌকুমার্য, অর্থব্যক্তি, উদারতা ও কান্তি । তাঁরা একে বলেন , "বিশিষ্টা  পদরচনা রীতি:" । অর্থাৎ যেকোন কাব্যে এমন ভাবে শব্দ ও অর্থের সন্নিবেশ ঘটাতে হবে যাতে তা নানা গুণের প্রকাশক হয়ে ওঠে ।
           

                       স্টাইল শব্দটি ইংরেজি ভাষায় ১৮৪৬ সালে বিশেষ্য পদ রূপে পাওয়া যায়। আর 'স্টাইলিসটিক' শব্দটি শৈলীবিজ্ঞান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছিল ১৮৬০ সালে । ১৮৮২ সাল থেকে ইংরেজি ভাষায় 'স্টাইলিসটিক' শব্দটির ব্যবহার শুরু হয় । ১৮৭২ সালে ফরাসিরা শৈলীবিজ্ঞানকে  'La Styli stique ' রূপে আখ্যাত করেন। আর এখান থেকেই জন্ম নেয় বাংলায় ' শৈলীবিজ্ঞান' । 
                         প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যে শৈলী বিষয়টি ছিল মূলত: রেটরিক বা অলংকার শাস্ত্রের অন্তর্গত । পরবর্তীকালে শৈলীর ক্ষেত্র অনেক প্রসারিত হয়েছে । এখন অলংকার এর পাশাপাশি ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব , বাক্যের অন্বয় , ছন্দ ইত্যাদি শৈলী চর্চার অঙ্গীভূত । কবি সাহিত্যিকদের রচনায়  যুগ পরিবেশের প্রভাব যেমন থাকে, তেমনি একই যুগের মধ্যে বাস করেও এবং একই বিষয় নিয়ে সাহিত্য রচনা করেও দুজন কবি দুই রীতির রচনা পাঠক কে উপহার দিতে পারেন। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টোটল স্টাইল সম্পর্কে বলেছিলেন ,  'style is invented by the poet himself '. 
ঠিক একই কথা বলেছিলেন বুঁফো , ' style is the man himself.'
জনসন ভালো লেখার অন্যতম শর্ত হিসেবে লেখকের নিজস্ব স্টাইলের বিশেষ অনুশীলনের কথা বলেছিলেন। স্টাইল সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি সর্বপ্রথম বিষয়বস্তুর ভাবনার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কারণ কোন্ কথা কিভাবে লেখা উচিত তা বিষয়বস্তুর ভাবনা থেকেই লেখকের মনে জন্ম নেয় । তারপর আছে শব্দ নির্বাচন, রচনা সৌষ্ঠব , বাক্য শব্দের যথোচিত বিন্যাস । তাঁর মতে আন্তরিক পরিশ্রমের সঙ্গে ঘনঘন অভ্যাস ও অনুশীলন ছাড়া স্টাইল আয়ত্ত করা যায় না। 
উনিশ শতকের লেখক Walter Peter বলেছিলেন,  জ্ঞানে হোক অজ্ঞানে হোক লেখক জগতের বস্তু সত্যের চেয়ে বস্তুর "বোধসত্যের" উপর অধিক গুরুত্ব দিলে , তবেই যথার্থ শিল্পীর মর্যাদা লাভ করবেন। 
স্টাইল শব্দটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রখ্যাত সমালোচক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত তাঁর "কাব্য বিচার" গ্রন্থে লিখেছেন , 
"ইংরেজিতে style বলিতে যাহা বুঝা যায় তাহার তাৎপর্য এই যে, প্রত্যেক চিন্তাশীল লেখক এর চিন্তার একটি স্বতন্ত্র ধারা আছে। লেখকের যে বক্তব্য বিষয় তাহা তাঁহার অন্তর হইতে একটি বিশিষ্ট ক্রমে সজ্জিত হয় এবং সেই ক্রমের অনুকূল তিনি শব্দ সঞ্চয় ও শব্দ ব্যবহার করেন । তিনি যেভাবে উপমা আহরণ করেন, যেভাবে একটি শব্দের সাথে আরেকটি শব্দ সংযোজন করেন, তাঁর চিন্তার বিভিন্ন অংশগুলি যেভাবে সাজান , বক্তব্য অর্থকে যেভাবে প্রকাশ করতে চেষ্টা করেন, সেটা তাঁর চিন্তাধারার অঙ্গীভূত। চিন্তাধারার পার্থক্যই  style -এর পার্থক্য ।"

                    একটি দৃষ্টান্ত দ্বারা বিষয়বস্তুটিকে আরো একটু সরল করা যেতে পারে । যেমন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি গানে লিখেছেন :

"মোর বসন্তে লেগেছে যে সুর / বেনুবন ছায়া হয়েছে মধুর / থাকনা এমনই গন্ধবিধুর / মিলন কুঞ্জ সাজানো ।"
লক্ষণীয়, কবিগুরু এখানে 'বেনুবন' শব্দটি ব্যবহার করেছেন । 'বাঁশবাগান' বা 'বাঁশবন' ব্যবহার না করে।
আবার দেখা যাক, কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী তাঁর 
'কাজলাদিদি' কবিতায় লিখলেন :

"বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই
 মাগো, আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই ।"

কবি যতীন্দ্রমোহন এখানে 'বেনুবন' ব্যবহার না করে, 'বাঁশবাগান' শব্দটি চয়ন করলেন । এটাই শৈলীর পার্থক্য ।

__________________________________________

আরও পড়ুন 


        
Previous
Next Post »

এই ব্লগটি সন্ধান করুন