বাংলা ছোট গল্প //bengali short story

বাংলা_ছোট_গল্প //bengali_short_story


 একলাপুর


—পঙ্কজকুমার বড়াল


এক এক দিন ঘুম থেকে উঠে বিপুলের মনে হয়, আজ তার একলাপুর যাবার কথা৷ তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়ে, ব্রাসে টুথপেষ্ট দিতে গিয়ে ব্যথার মলম দিয়ে ফেলে৷ সারাক্ষণ খুব যেন তাড়া থাকে তার মনে৷ এসবের মাঝেই সে টেরপায় বাথরুমে তার বাবা কাশছে, মা রান্নাঘরে টুকটাক কাজ সারছে৷ উঠোনের আম গাছটিতে কয়েকটি কাক বসে অনবরত  ডেকেই চলেছে৷ ঘোষদা এসে তিন পোয়া দুধ দিয়ে গেছে৷ উঠোনে পায়চারি করতে করতে দেখে— পাশের বাড়ির বাচ্চুকাকা রাস্তার পাশে পেচ্ছাপ করছে৷ বিপুলকে দেখে সে খ্যা-খ্যা করে হাসে৷ বিপুলের কেবলই মনে হয় দেরি হয়ে যাচ্ছে৷ হোঁচট খেতে খেতে সে সোজা হয়ে দাঁড়ায়৷ তারপর মাকে চা দিতে বলে৷ দ্রুত খেতে গিয়ে জিভ পুড়ে ওঠে৷ কাপটি ছুঁড়ে দেয় সে৷ হঠাৎ মণি এসে হাজির হয়, তার পিসতুতো ভাই৷ দাদা তাড়াতাড়ি এসো— বলেই মণি ব্যাকুল ও উদ্বিগ্ন মুখ তুলে তাকায়৷ বিপুল জিজ্ঞেস করে— কী হল রে! তারপর সব শুনে দৌড়ে পিসির বাড়ি  গিয়ে দেখে পিসিমা খাট থেকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে আছেন৷ একলাপুর.. একলাপুর.. বিড়বিড় করতে করতেই অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করে বিপুল৷ তার ভিতরে এক অসহ্য অস্থিরতা কাজ করতে থাকে৷ গতকাল অফিস থেকে দুদিনের ছুটি নিয়েছে সে৷ আজ তার ছোটবোনের আসার কথা, পুলুমাসির আসার কথা৷ অনেকদিন পর এই দুদিন বাড়িতে জমজমাট আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া হবার কথা৷ অথচ যে করেই হোক আজ তাকে একলাপুর যেতেই হবে৷ এক অদৃশ্য অমোঘ টান তার সমস্ত দেহ-মনকে ব্যাকুল করে রেখেছে সেই একলাপুর৷

সোহিনীর সাথে বিপুলের কথা নেই আজ দু'মাস হয়ে গেল৷ কিছুদিন তীব্র অশান্তি তারপর সব যোগাযোগ বন্ধ৷ সোহিনীর দিদির দেওর শুভর সাথে কিছুদিন থেকেই ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল, সেটা নিয়েই অশান্তির শুরু৷ তারপর তো একদিন হাতেনাতে ধরেছিল বিপুল৷ এক বিছানায় ওদের দুজনার সেই উলঙ্গ দৃশ্য মনে পড়লে বিপুলের এখনও মরে যেতে ইচ্ছে করে৷ অথচ শুভ বিবাহিত৷ সোহিনী তারপরেও দাবি করেছিল তারা জাস্ট বন্ধু৷ শালা বিপুলকে চুদু মনে করেনাকি সবাই! সোহিনীও বলেছিল— বিপুলের নাকি মাথার ঠিক নেই, তার নাকি এইভাবে খোলামেলা না থেকে পাগলখানায় থাকা উচিত৷ এসব কথা মনে পড়লে বিপুলের তেড়ে গাল দিতে ইচ্ছে হয়৷ চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়৷ শুভর সাথে সোহিনীর শোয়া নিয়ে বিপুলের আপত্তি করা নাকি সাজে না৷ তার শরীর সে যাকে ইচ্ছে দেবে৷ দিক, দিক সে৷ বিপুল আর ভাবতে চায় না সে কথা৷ যে করেই হোক, একলাপুর যাওটা বড্ড দরকার৷ পিসিকে অ্যাডমিট করে সুকুকে ফোন করে সে৷ সুকুমার, বিপুলের ক্লাসমেট, এই হসপিটালের ডিউটিতে ছিল কিছুদিন৷ ওর সোর্স কাজে লাগিয়ে যদি বেটার ট্রিটমেন্ট পাওয়া যায়! তার সাথে কথা বলে মণিকে ডাকে সে৷ কাঁধে হাত রেখে হঠাৎ বলে— তুই একলাপুর চিনিস? মণির মুখ শুকনো৷ সে যেন অবাক হতেও ভুলে গেছে৷ মণি দুদিকে মাথা নেড়ে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে বিপুলের দিকে৷ বিপুল বলে— চিন্তা করিস না, পিসির কাছে থাক, কিচ্ছু হবে না পিসির৷ তারপর মাকে ফোন করে, বলে— বাবাকে চিন্তা করতে নিষেধ করো আর বাবার ওষুধটা খাইয়ে দাও সময় মতো৷ ফোন রেখে আবার তার সোহিনীর কথা মনে আসে৷ একবার কী সোহিনীর বান্ধবী পায়েলকে ফোন করবে সে? ফোন করে সোহিনীর খোঁজ নেবে? শুভকে ফোন করে কি গালাগাল দেবে? ভাবতে ভাবতে বাসস্ট্যাণ্ডে গিয়ে দাঁড়ায়৷ নাঃ ভুলতে হবে সোহিনীকে, যে করেই হোক— বিড়বিড় করতে করতে  ৩২৬ বি বাসে উঠে পড়ে বিপুল৷ কেবিনে বসে সিগারেটের প্যাকেট বের করতেই কন্ডাক্টর রে রে করে ওঠে৷ পকেটে সিগারেট ঢুকিয়ে রেখে মনে মনে বলে ফাক্ ইউ! বাস ছুটতে থাকে৷ কেবিনে ইঞ্জিনের গরম, হাওয়া ঢোকে না৷ পুরোনো বাস, গাঁই গাঁই করে শব্দ হচ্ছে৷ কতক্ষণ কেটেছে খেয়াল করেনি সে৷ কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে মুখটা কেমন যেন তেতো হয়ে গেছে, মেজাজটাও৷ বাসে এক হকার লেবুলজেন্স, ঝাল লজেন্স বলে চিৎকার করছে আর বাসের ঝাঁকুনিতে টাল সামলাচ্ছে৷ অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে বিপুল থুথু গিলে নেয়৷ পাশাপাশি সিটে কলেজপড়ুয়া দুটি ছেলে মেয়ে বসা৷ এমন ভাবে বসে আছে যেন ওদের ফুলসজ্জার রাত৷ ছেলেটি রীতিমতন মেয়েটির স্তনের উপর হাত রেখে হাল্কা চাপ দিতে দিতে জগৎ ভুলে আছে৷ এসব দেখে বিপুলের মুখে আবার থুথু জমে৷ কন্ডাক্টর এসে বিপুলকে বলে— দাদা কোথাকার টিকিট দেব? বিপুল  আনমনে বলে ওঠে— একলাপুর৷ অবাক মুখে কন্ডাক্টর জিজ্ঞেস করে সেটা আবার কোথায়? বিপুল যেন একটা ধাক্কা খায়৷ অগত্যা! যা হবার সেটাই হয়৷ বাস থামিয়ে দড়াম করে দরজা খুলে দেয়৷ মাঝরাস্তায় নেমে রোদে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায় বিপুল৷ সে কি ফোন করবে কাউকে? নাহ্! চাঁদি ফাটা রোদ৷ একটা ম্যাটাডোরকে আসতে দেখে হাত দেখায় সে, না থেমেই চলে গেল গাড়িটি৷ রাস্তার পাশদিয়ে একটা সরু মেঠোপথ নেমে গেছে জঙ্গলের দিকে৷ চারিপাশে তাকায় বিপুল৷ আশেপাশে কোনো জনবসতি নেই৷ তার তেষ্টা পাচ্ছে খুব৷ ওই কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে মাটিতে বসে বা শুয়ে পড়লে কেমন হয়! ভাবতে থাকে সে৷ একলাপুরের পথ কি কেউ চেনে না! এ কথায় সে কথায় অনেককেই জিজ্ঞেস করেছে আগে, কেউ সন্ধান দিতে পারেনি৷ অথচ তার পাগল পাগল লাগে৷ সোহিনী হয়ত ঠিকই বলে, বিপুল ভাবে— আমার মাথাটা কি সত্যিই তাহলে! তারপর নিজেকেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়— আচ্ছা, একলাপুরে কী আছে? কে আছে এমন! এত ব্যাকুল লাগে কেন তার! 

আচমকা মনের ভিতর ঝিলিক মেরে ওঠে বিপুলের৷ মনামী, ওর মামার বাড়ি ছিল হৃদয়পুর৷ একলাপুর কি হৃদয়পুরের কাছের কোনো জায়গা! কে জানে! বিপুলের মনে আছে— ক্লাস নাইনে পড়ার সময় মনামীকে ভাল লাগত তার৷ মনামী তখন এইটে পড়ে৷ ওর বাবা ছিল ভুগোলের মাস্টার৷ যা রাগী! একদিন বেত দিয়ে পাছা লাল করে দিয়েছিল৷ সেই শোধ নিতে স্কুল ছুটির পর মনামীকে জোর করে চুমু খেয়েছিল সে৷ রাগে, লজ্জ্বায়, ঘটনার আকস্মিকতায় মনামী এমন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল যে পাঁচমিনিট পরে সে ছিঃ! শব্দটা উচ্চারণ করে ভয়ে ভয়ে আসে পাশে দেখছিল ঘটনাটা কেউ দেখে ফেলল কিনা৷ তারপর এক দৌড়ে বাড়ি চলে গিয়েছিল৷  কিছুদিন পর থেকে ধীরে ধীরে মনামীর সাথে ভাব-ভালবাসা হয়েছিল অবশ্য! কিন্তু টেকেনি বেশিদিন৷ জীবনের প্রথম আধ-খামচা শারিরীক সম্পর্কও হয়েছিল তার সাথে৷ এখন আর যোগাযোগ নেই৷ বিপুল শূন্যে কথা ছোঁড়ে—কী করে সে এখন? বিয়ে হয়েগেছে কি! ফোন করে দেখবে নাকি সুকুমারকে! সুকু কি জানে মনামীর কথা? জানলেও মনে আছে কি এতদিন আগের সব?

পকেটে হাত দেয় বিপুল৷ ফোনটা হাতে নিয়ে ভাবে বাড়িতে ফোন করে মা কে বলবে— একলাপুর যাচ্ছিলাম, কোথাও একটা চলে এসেছি৷ কিন্তু ফোন করে না সে৷ গালাগাল দিয়ে ওঠে— ধুস্ শালা কোথায় এসে পড়লাম!আসলে ফোনের নেটওয়ার্কও নেই যে ফোন করবে কাউকে৷ তার চোখ যায় যেখানে মাটির সরু ঘাসে ঢাকা রাস্তাটা জঙ্গলে মিশেছে৷ একটি মস্ত গোসাপ৷ ফোঁস ফোঁস করছে আর চেরা মোটা জিভ হাত খানেক বাইরে বের করে যেন বাতাস চাটছে৷ এতবড় গোসাপ হয় নাকি! এ তো ছোট-খাটো ডাইনোসর! অবাক লাগে বিপুলের৷ ওই জঙ্গলে কি ম্যামথও আছে নাকি! আজব জায়গা মাইরি! নাঃ এখানে থাকা যাবে না বেশিক্ষণ৷ জনশূন্য এই জায়গাকে তার প্রাগৈতিহাসিক বলে মনে হয়৷ সামান্য ভয় ভয় লাগতে থাকে৷ গলা শুকিয়ে কাঠ, খিদেও পাচ্ছে তার৷ রাস্তার দিকে দূরে তাকায় সে৷ একটা বাস অাসছে মনে হচ্ছে! কাছাকাছি আসতেই দৌড়ে রাস্তার মাঝে গিয়ে  চিৎকার করতে থাকে— ও দাদা ধর্মদহ যাবে? অবশেষে হাঁফ ছাড়ে সে৷ যাক বাঁচোয়া৷ ঘন্টা তিনেক পরে বাসস্ট্যাণ্ডে নামতেই কেমন বমি বমি পেতে শুরু করল তার৷ পা যেন একটু একটু টলছে! কেমন অন্ধকার দিয়ে আনছে! এসময় তো তার একলাপুরে থাকার কথা ছিল! অথচ হল না যাওয়া৷ আরও একটা ব্যর্থ দিন জীবনের৷ বিপুলের মনে হতে থাকে— বাস-গাড়ির তীব্র হর্ণ, পেট্রোল পোড়া গন্ধ, জামা কাপড়ে হসপিটালের গন্ধ, শালা শুয়োর শুভর ব্যবহার করা কণ্ডোমের গন্ধ, মনামীর মাসিক-প্যাডের গন্ধ, অফিসের সোমবাবুর মুখের উৎকট গন্ধ, সব ক্রমে দলাপাকিয়ে ধেয়ে আসছে  তার দিকে৷  জগৎ সংসার যেন দুলছে, সেখানে একলাপুর বলে কোন জায়গা নেই৷ যাহ্ শালা! বিড়বিড় করতে করতে এলিয়ে পড়ে বিপুল— জনারণ্যে, একা৷
Previous
Next Post »

এই ব্লগটি সন্ধান করুন