ছবি
শক্তি সামন্ত
রাজেশের জীবনটা ছিল সাদামাটা, কিন্তু তার একটা অদ্ভুত শখ ছিল—পুরনো জিনিসপত্রের প্রতি অগাধ আকর্ষণ। যেখানেই কোন পূরানো জিনিস বিক্রি হতো সেই সব নিলাম থেকে কিছু না কিছু কিনে আনা তার নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। তাঁর পছন্দের বিষয় ছিল প্রাচীন বস্তু সামগ্রী।
আজকের এই নিলামেও বসে রাজেশ আশায় বুক বাঁধে, হয়তো আজ কিছু দুর্লভ ও মূল্যবান কিছু খুঁজে পাবে, যা তার সংগ্রহে নতুন মাত্রা যোগ করবে। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক নিদর্শন, প্রাচীন মূর্তি, দুর্লভ পাণ্ডুলিপি এবং অসংখ্য শিল্পকর্মের ভিড়ে তার মনোযোগ আসা যাওয়া করছে, সে খুঁজে নিতে চাইছে এমন এক দূর্লভ জিনিস যা তাকে সমৃদ্ধ করবে। কিন্তু কিছুই যেন তাকে গভীরভাবে আকর্ষণ করতে পারছে না।
একটি অলৌকিক ছোট গল্প | ছবি | Image
সব জিনিসেই চোখ বুলিয়ে চলেছে।
হঠাৎ তার চোখে পড়ে একটি রহস্যময় চিত্রকলার ওপর। ছবিটিতে একটি প্রাসাদ, তার নিচে দাঁড়িয়ে আছে কিছু মানুষ। কিন্তু অদ্ভুতভাবে তাদের মুখগুলো অস্পষ্ট, যেন শিল্পী ইচ্ছাকৃতভাবেই অস্পষ্ট ভাবেই এঁকেছেন এই ছবিটা, কিন্তু কেন? ছবিটি দেখে রাজেশের মনের ভেতর এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করতে শুরু করেছে। তার মনে হল, ছবির মানুষগুলো যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে, তাকে কিছু বলতে চাইছে।
কেন কে জানে! এই চিত্রকলার প্রতি রাজেশ এক অমোঘ আকর্ষণ বোধ করতে থাকে। তার মনের ভেতরে এক ধরনের জিজ্ঞাসা তৈরি হয়—এত সুন্দর এবং রহস্যময় চিত্রকলা, কিন্তু কে আঁকলো? কেন মুখগুলো অস্পষ্ট? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগ্রহে সে ছবিটি কিনে ফেলে। নিলামে তেমন কোন প্রতিযোগী ছিল না, কারণ অন্য কারো চোখে বোধহয় ছবিটি বিশেষভাবে ধরা পড়েনি। রাজেশ ছবি নিয়ে বাড়ি ফিরে নিজের বসার ঘরের দেওয়ালে তা টাঙিয়ে দিল।
একটি অলৌকিক ছোট গল্প | ছবি | Image
সেই রাতেই প্রথম অদ্ভুত ঘটনাগুলো ঘটতে শুরু করে। রাজেশ ঘুমানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু তার মন অস্থির। বারবার মনে হচ্ছিল, সেই চিত্রকলার মানুষগুলো তাকে দেখতে পাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল, কিছুক্ষণ পর সে অদ্ভুত স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়ল। স্বপ্নে সে দেখল সেই প্রাসাদটিতে সে নিজে হেঁটে বেড়াচ্ছে। সেখানে কিছু অস্পষ্ট চেহারার মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা মুখে কিছু বলছে না, শুধু নীরবে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তাদের চোখে অদ্ভুত এক যন্ত্রণা এবং শূন্যতা ফুটে উঠেছে। রাজেশের হঠাৎ মনে হলো, তাদের সাথে সে নিজেও কোথাও আটকে গেছে, কোনো এক অজানা অভিশাপে।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রাজেশ সিদ্ধান্ত নিল, এই ছবির রহস্য তার উন্মোচন করতেই হবে। দিনের বেলা কিছুই অস্বাভাবিক মনে হয়নি, তবে রাত বাড়ার সাথে সাথে আবারও অদ্ভুত অনুভূতি ফিরে আসে। প্রতিদিনই সে যেন ছবিটির প্রতি আরও বেশি আকৃষ্ট হতে থাকে, যেন ছবির ভেতরকার মানুষগুলো তার সাথে কথা বলতে চাইছে।
একটি অলৌকিক ছোট গল্প | ছবি | Image
একদিন সন্ধ্যায় রাজেশ খেয়াল করল, ছবির প্রাসাদটা একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। এটি আর সেই রহস্যময় প্রাসাদ নয়, বরং তার শহরের কাছে অবস্থিত একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত পুরোনো বাড়ির মতো দেখতে হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ! এতটা মিল কিভাবে সম্ভব? ছবিটির পরিবর্তনশীলতা তাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। কোন জড়বস্তু কিভাবে বদলে যেতে পারে!নাকি এটা তার মনের ভুল!
বাড়িটি বহু বছর আগে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তার কিছু অংশ আজও দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু সেই ঘটনার ইতিহাস সবারই অজানা। রাজেশের মনে এক ভয়ংকর সন্দেহ জাগে—এই চিত্রকলার সাথে সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ির কি কিছু সম্পর্ক আছে?
একটি অলৌকিক ছোট গল্প | ছবি | Image
এটা জানার জন্য তিনি গভীর গবেষণায় লেগে পড়েন। পুরনো ইতিহাসের বই থেকে তিনি জানতে পারেন, সেই বাড়িটি এক জমিদারের ছিল, যিনি অত্যন্ত ক্ষমতাশালী ও নিষ্ঠুর ছিলেন। তার রাজত্বকালে সেই এলাকায় অনেক অত্যাচার, যুদ্ধ এবং মৃত্যু হয়েছিল। একদিন জমিদারসহ তার পুরো পরিবার রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়। কেউ জানে না তারা কোথায় গেল, কিংবা কীভাবে তাদের এমন অদ্ভুতভাবে হারিয়ে যেতে হলো।
রাজেশ বুঝতে পারেন, ছবির প্রাসাদটি সেই অভিশপ্ত জমিদার বাড়ির প্রতিচ্ছবি, এবং ছবির অস্পষ্ট মানুষগুলো সেই জমিদার ও তার পরিবার হতে পারে।
একটি অলৌকিক ছোট গল্প | ছবি | Image
রাতে আবার স্বপ্ন আসে, এবং এবার তা আরও স্পষ্ট হয়ে দেখা যায়। এবার রাজেশ নিজেকে সেই প্রাসাদের ভেতরে দেখতে পায়, যেখানে আগের মতোই সেই অস্পষ্ট মুখের মানুষগুলো তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে একজন তার দিকে এগিয়ে আসে এবং ফিসফিস করে বলে, "তুমি আমাদের মুক্তি দাও।" রাজেশ ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে পড়ে, সে আতঙ্কিত হয়ে যায়, তার শরীর ভিজে গেছে ঘামে। সে অনুভব করে, এই স্বপ্ন কোনো সাধারণ স্বপ্ন নয়—এটি তার কাছে আসা এক ধরনের আহ্বান, একটি ইঙ্গিত।
ছবির রহস্য জানতে না পারলে তার মনে শান্তি নেই, তাই সে স্থীর করে সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িটির ভিতরে যাবে সে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ।
কিছুদিন পর, রাজেশ ছবির রহস্য উন্মোচন করতে সেই ধ্বংসস্তূপের সামনে এসে দাঁড়ায়। বাড়িটি পুরোনো দিনের সাক্ষী বহন করে চলেছে, তার গায়ে লেগে আছে ধ্বংসের চিহ্ন। সেখানে পৌঁছে রাজেশ মনে করে, ছবির রহস্য হয়তো এখানেই লুকিয়ে আছে। সে ভেতরে প্রবেশ করে এবং বাড়ির ভেতরকার কিছু অংশে আশ্চর্যজনকভাবে ছবির মানুষগুলোকে সে অনুভব করতে পারছে। সে তাদের দেখতে পাচ্ছে না ঠিকই কিন্তু তাদের উপস্তিতি টের পাচ্ছে।তারা যেন রাজেশেরই অপেক্ষায় ছিল, তাকে যেন তারাই ডেকে নিয়ে এসেছে এখানে।
বাড়ির এক কোণে রাজেশ একটি পুরোনো সমাধি আবিষ্কার করে, যেটি কালের গর্ভে প্রায় মুছে যেতে বসেছে।সমাধিফলকের ওপর একটি নাম খোদাই করা—জমিদারের নাম। সে ভাবলো, তাহলে হয়তো, তার অপরাধের কারণেই তিনি ও তার পরিবার অভিশপ্ত হয়ে ছবির মধ্যে বন্দী হয়ে আছে, মুক্তির অপেক্ষায়। রাজেশ বুঝতে পারে, এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য জমিদারের অপরাধের ন্যায়বিচার করতে হবে।
কিন্তু তার এই অনুভবের সাথে সাথেই ততক্ষণাৎ কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। রাজেশ অনুভব করে, ছবির প্রভাব তার ওপর ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। তার শরীর যেন হালকা হতে শুরু করেছে, তীব্র একটা আলোর স্রোত তাকে টেনে নিচ্ছে। এতো আলো সে আগে কখনো দেখেনি। আলোর ঝলক এতো বেশি যে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। চতুর্পাশে শুধু ধুধু করা সাদা। সে ধীরে ধীরে অনুভব করে, তার অস্তিত্ব যেন অন্য স্তরে পৌঁছে যাচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছে না সে, কি হচ্ছে তার সাথে।
আবার সব শান্ত হয়ে গেল, যেন একটা ঝড় বয়ে গেল তার উপর দিয়ে। এখন অনেকটা রিল্যাক্স বোধ করছে। চোখ মেলতেই সব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। রাজেশের মন থেকে ভয়টা এখন কেটে গেছে বুকটা এখনো ধক ধক করছে। পরক্ষণেই সে অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো, এ কোথায় এসে পৌঁছেছে সে! তার চোখে সেই নিলাম ঘর সেখানে আবার সব জিনিস পত্র নিলাম হচ্ছে। এ কি অবাক কাণ্ড! সে-তো সেই পোড়োবাড়িতেই ছিল এখানে এল কি করে! তাহলে কি এতদিন কিছুই ঘটেনি। সে কি স্বপ্ন দেখছিল নাকি সেই ছবি দেখতে দেখতে এত কিছু নিজের মনেই ভেবে গেছে? কিন্তু আরও বেশি অবাক হওয়ার বাকি ছিল তার, যখন দেখলো, একজন বয়স্ক মানুষ তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে, তার চোখে ঠিক সেই আগ্রহ, যা একদিন রাজেশের চোখে ছিল ছবিটি কিনবার সময়। সে লোকটাকে কিছু বলতে গিয়ে দেখল, মুখ থেকে একটাও শব্দ বের হচ্ছে না।সে স্পষ্ট বুঝতে পারলো তার পাশে সেই অস্পষ্ট মুখের মানুষগুলো দাঁড়িয়ে আছে, ভয়ে তার বুক কেঁপে উঠল।
সে দেখতে পেল একজন বয়স্ক মানুষ ধীরে ধীরে নিলাম ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে। আশ্চর্যজনক ভাবেই নিলাম ঘরের ছবিটার কাছে এসে দাঁড়াল। চোখ তুলে দেখল ছবিটার দিকে। ছবিটার প্রতি তার আশ্চর্য কৌতুহল হল। একটা প্রাসাদ তার নিচে দাঁড়িয়ে আছে কিছু অস্পষ্ট মুখের মানুষ। কিন্তু এবার তাদের মধ্যে নতুন একজন যোগ হয়েছে—রাজেশ নিজেই।
🙏
ConversionConversion EmoticonEmoticon