মন ভাঙনের পাড়ে
শক্তি সামন্ত
বাংলা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস মন ভাঙনের পড়ে ভাগ 13
[তের] পরিনাম
[বাংলা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস মন ভাঙনের পড়ে ভাগ 13]
মানুষ চাইলে চাঁদে পৌঁছতে পারে। পারে হয়ত মঙ্গলে পারি জমাতে।আগুন নিয়ন্ত্রণ করতেও পারে।
জলকে বেঁধে রাখতে পারে। হাওয়াকেও বন্দি করে বেলুনে উড়িয়ে দিতে পারে আকাশে। শুধু
পারে না যেটা এই সময় কে ধরে রাখতে। সব কিছুই যে একই নিয়মে চলবে তার কোন মানে
নেই। পরিবর্তনই প্রকৃতির সব থেকে বড় নিয়ম।আর সেই সময়ের নিয়মে ডুবে থেকে মানুষ কত
কিছু হারায় আবার অনেক কিছুই পেয়ে যায়। সুখ দূঃখ সময়ের এই চক্রে ঘুরতে ঘুরতে মানুষ কোথা
থেকে কোথায় পোঁছে যায় কে বলতে পারে।
সমস্ত ভালো যাকিছু শেষ হয়ে গেছে রূপকের জীবনে।এখন এক কঠিন সংগ্রামের জীবন শুরু হয়েছে
তার।শুধু মাত্র সুনিতার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রেখে জীবনময় আগুন গিলতে গিলতে কবি হয়ে গেছে।
কবিতা লিখেতো আর পেট চলে না তাকে অন্য কিছু করতেও হয়।ব্যাঙ্গলোরের কাজটা ছেড়ে দিয়েছে
বিয়ের আগেই। অনলাইন কিছু কাজ কর্ম করে চালিয়ে নেয় সংসার।
[বাংলা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস মন ভাঙনের পড়ে ভাগ 13]
একটা মেয়ে হয়েছে তার ফুলের
মত সুন্দর। সবার কাছে বলে বেড়ায় তার মেয়েই তার পৃথিবী। কিন্তু সোমার মনে অসন্তোষের আগুন
কন্যাসন্তান বলে।কারণ সে চেয়েছিল পুত্রসন্তান।তাছাড়াও রূপক ততধিক বিলাসিতায় রাখতে
পারেনি
তাকে। এরেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছিল, বিয়ের প্রথম প্রথম সেকি ভালবাসা সোমার। হয়ত ভেবে ছিল রূপকথার রাজপুত্র পেয়ে গেছে। কিন্তু কয়েক মাস পরেই তার সব মোহ ভঙ্গ হয়ে যায়।
শুরু হয় মান অভিমানের
পালা ছোট খাটো বিষয় নিয়েই। যদিও বড়সড় কোন গণ্ডগোল হয়নি।
কারন রূপক হার মেনে নেয় সহজেই। সে জানে অশান্তির আগুনে তার মেয়ের জীবনটাই নষ্ট হয়ে
যাবে। তাছাড়া কতটুকুই বা তার সাধ্য।
বাবাও আজকাল তাকে উঠতে বসতে লাঞ্ছনা দেয়। বয়স হয়েছে তাঁর।
[বাংলা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস মন ভাঙনের পড়ে ভাগ 13]
সব বাবা-মা'রাই চায় তার সন্তানকে রসেবশে দেখতে। মা এখন তার প্রতি কেমন যেন উদাসীন ,বলে,
"চেষ্টাতো করেছিল ভাগ্যে না থাকলে কি আর করবে।" ভাগ্য বলে কিছু হয় কিনা জানে না রূপক।
কিন্তু মায়ের এই কথাটা তাকে বড্ড আরাম দেয়। এই স্নেহের ছায়াতেইতো চোখ বন্ধ করে হাতের
তালুর উপর মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে নেওয়া যায়।
এত বেশি প্রচারিত হয়ে যাবে তাদের ভালবাসার গল্প রূপক কখনই ভেবে দেখেনি।পাড়ার প্রায়
সকলেই জানে।আসলে তাদের প্রেমের আগুন ততটাও জ্বলেনি যতটা ধোঁওয়া উঠেছিল। এইতো সেদিন সেলুনে চূল কাটতে গিয়ে নবীন নামে অল্প পরিচিত একজন জিজ্ঞেস করেই বসল রূপককে।" রূপকদা বিয়েটা তাহলে কবে হচ্ছে।প্রেমটাতো চুটিয়ে করছ সুনিতার সাথে।"
রূপক আশ্চর্য হয়ে চোখ বড় বড় করে ঘুরে তাকাল নবীনের দিকে। সেলুনওয়ালা শম্ভুদা বলল,
"ওরতো বিয়ে হয়ে গেছে। একটা মেয়ে। " এবার হাসতে হাসতে রূপক জিজ্ঞেস করল ,"তুমি কি
করে জানলে যে আমি সুনিতার সাথে প্রেম করেছি?"
এবার নবীন বলল , "যাব্বাবা ! বাজারের সবাই জানে তোমাদের গল্প।"
রূপক চুপ করে গেল।
[বাংলা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস মন ভাঙনের পড়ে ভাগ 13]
কিছুক্ষণ পর আবার বলল, "ওটা গল্পই, সত্যি নয়।" রূপক আর কথা বাড়াল না ,সেভিং করে
বেরিয়ে এল সেলুন থেকে।
রূপক কি সুনিতাকে ভুলতে পারবে না । না পারারই কথা । এখনও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে
পায়। সে শরতের বিকেল, হেঁটে আসছে স্কুল শাড়ি আর অধির আগ্রহে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে সে।
বকুলতলার মাঠে সেই প্রথম দেখা তারপর কয়েক বছর ধরে সাইকেল করে তার পিছু নেওয়া। নাওয়া
খাওয়া ঘুম সব ছুটে গেছিল।
সেই এক ঝলক একবার
দেখা পেলে মনে কতযে সুখের ঝড় বয়ে যেত। আর হৃদয়ের পরতে পরতে শান্তি বিরাজ করত।
সুনিতাকে নিয়ে তার নামে প্রচারিত এই কথা ।লোকের মুখ থেকে মুখে অতপর সোমার কানে গিয়ে
উঠলে সে এক ঝামেলা। "তুমি যদি সুনিতাকেই ভালবাসো আমার জীবন নষ্ট করলে কেন?" রূপক
বার বার এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয় ।
শুধু প্রশ্ন বললে ভূল বলা হবে, সমস্যা বলাই ভালো। প্রথম প্রথম অনেক বোঝাত কিন্তু এখন রূপক ভেবে নিয়েছে চুপ করে থাকায় ভালো।
খুব অবাক লাগে তার, যে সুনিতার সাথে তার কোন কালেই আলাপ পর্যন্ত হয়নি। সে বিষয়ে তার
এত সমস্যা হবে! আসলে রূপক নিজেই বুঝে উঠতে পারেনা এই জীবনটাকে। যার নিজের জীবন
নষ্ট হয়ে আছে বহু আগে থেকেই। তার জীবনে যেই আসবে সেতো কষ্ট পাবেই।
যখনই একা একলা থাকে তখন বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। যাকে সে
ভালবাসল তাকে পেল না যাকে পেল তাকে নিয়ে সে ভালো নেই। জীবনের এই রঙ পরিবর্তনের
খেলায় পেরে উঠে না রূপক।মাথার মধ্যে অজস্র ভাবনা,অনুভূতি কিলবিল করে শব্দ হয়ে ঝর্নার মতো
ঝরে পড়তে চায় আর সে কবিতা লেখে।
একটা ভাল জীবন সে চেয়েছিল ছোট-খাটো একটা চাকরী আর মনের মতো প্রেমিকা।উচ্চাশা
তেমন কিছুই ছিল না।আনন্দ পুরের সেই মেয়েটার কথা মনে
পড়লে নিজের মনেই হেসে উঠে। রিমার প্রতি মোহ ভঙ্গ হয়েছিল সেদিন দূর্গা পূজার নবমীতে
চাঁইপাট ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে প্রেম করতে দেখেছিল রিমাকে রূপকেরই পরিচিত মইনুলের সাথে।
তার পর থেকে আর এমন বহুগামি রিমার দিকে ফিরেও তাকায়নি কোন দিনই।আসলে সে জানত
রিমা তাকে কোনদিনই ভালবাসেনি।সে চেয়েছিল বিতানকে।তার সাথে শুধুই নাটক আর মিথ্যে বলে
গেছে রাশি রাশি। এটাই স্বাভাবিক রূপকের থেকে ঢের বেশি স্মার্ট বিতান ।
[বাংলা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস মন ভাঙনের পড়ে ভাগ 13]
সেখানে রূপককে পছন্দ করার কোন কারণ ছিল না। যখন সে জানতে পেরেছিল বিতান পিঙ্কিকে
ভালবাসে মুখ ফুটে আর কিছুই বলতে পারেনি রিমা।
শুধু রূপকের সাথে ভালবাসার অভিনয় করে গেছে। মনে আছে রূপকের, সেদিন বকুলতলার মাঠে
সরস্বতি পূজোর অনুষ্ঠানছিল।পূজোর দ্বিতীয় দিন রূপকের জীবনের অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ন ছিল সে
দিন। শুধু মহিলাদের একটা নাটক অনুষ্ঠিত হবে আর তার লিড চরিত্রে সুনিতা।
বিতানের মুখে সে খবর শুনেই তার মনে এক খুশির বাতাবরণ তৈরি হয়। প্রায় তিন-মাস পর সবে
দেশে ফিরেছিল সেদিন রূপক। দিন কয়েক ধরে রিহার্শাল চলছে ।
বিতানের কথায় ওরা চলল রিহার্শাল দেখতে । বিতানের আগ্রহের কারন ছিল পিঙ্কি । সেও
আছে নাটকে । রিহার্শাল দেখার সৌভাগ্য হয়নি যদিও কোন দিন।
কয়েকদিন পর সরস্বতি পুজোর নাট্য মঞ্চ কাঁপিয়ে দিচ্ছিল সুনিতা, পিঙ্কিরা।আর মঞ্চের নিচে
দর্শকদের একেবারে পেছনের সারিতে আর এক নাটক চলছিল রূপকের সামনে রিমার।
রিমা এসেছিল তার মাসির মেয়ে পরির সাথে।পরি বিকুর দূর সম্পর্কের বৌদি হয়। সেই সূত্রে
রূপক আর বিতানের পরিচিত।তারপর অনেক গল্প জমে উঠেছিল।
ওদিকে মঞ্চের উপর রূপকের ড্রিম গার্ল সুনিতা যা কখনও তাকে ধরা দেবে না।আর এখানে
বিতান ব্যার্থ চেষ্টা করে যাচ্ছিল রিমার সাথে রূপকের সেটিং করিয়ে দিতে।
রিমা রূপকের একেবারে গা ঘেঁসে বসেছিল।রিমার নরম শরীরের ছোঁয়ায় বেশ উত্তেজনা জাগছিল
রূপকের।আর রিমা একের পর এক শর্ত রেখেই যাচ্ছিল । তাকে ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে গিয়ে
রাখতে হবে।শ্বশুর শাশুড়ির সাথে থাকবে না।বাড়ির কাজ রান্না-বান্না
করতে পারবে না লোক রাখতে হবে। রূপক হাসি মুখে বলেছিল আচ্ছা বেশ! আর মনে মনে
বিদ্রুপ করে বলেছিল 'চাঁদ এনে দেব তোকে!'
তারপর বেশ কিছুদিন রিমার সাথে মেলামেশা চলতে থাকে। দেখাও করত পার্কে কিংবা রাস্তাঘাটে।
তারপর রূপকের মনে কোথাও এতটুকু হলেও রিমার প্রতি সুক্ষ্ম অনুভূতি জন্মেছিল।ছ-সাত মাস চলেছিল
তাদের এই মিথ্যা প্রেম।এটা ওটা অনেক কিছুই গিফট দিয়েছিল রূপক। সেসবের মূল্য আজ আর
নেই রিমার কাছেও,রূপকের কাছেও।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভুলে যেতে চেয়েছিল রুপক।জীবনের এমন
কিছু ঘটনা চাইলেও ভুলে থাকা যায় না। ঠিক কোন না কোন দূর্বল ক্ষণে ভেসে উঠে তার প্রতিচ্ছবি।
এদিকে সুনিতার কথাও মন থেকে মুছে দিতে পারছিল না রূপক।
তারপর একদিন বোধি এসে জানায়, সুনিতার বাবা কোলকাতায় সেটেল্ড হয়ে যাবে। সুনিতাও চলে যাবে
সেখানে, ফ্লাট নিয়েছে।সুনিতার দাদারও চাকরি হয়ে গেছে।
খালি সুনিতার এইচ এস পরীক্ষার জন্যে অপেক্ষা।সেদিন বটতলায় বসেছিল রূপক একটা পিকাপ
ভ্যানে করে সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিল সুনিতারা।
সুনিতাকে একটু খুশি খুশি মনে চলে যেতে দেখল রূপক। আর রূপক দূখভরা চোখে বহুদূর পর্যন্ত তাকিয়েছিল।
[বাংলা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস মন ভাঙনের পড়ে ভাগ 13]
না, কোন দিনই রূপক সুনিতার মনে এতটুকুও প্রভাব ফেলতে
পারেনি। না হলে অন্তত একবার হলেও ফিরে তাকাত।চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল চিরতরে বহুদূরে।
তারপর আর কোন খবর পায়নি রূপক।জীবনের একটা গুরুত্ব পূর্ণ অধ্যায় যেন শুরু হওয়ার আগেই
শেষ হয়ে গিয়েছিল।
চলবে...
**************
ConversionConversion EmoticonEmoticon