মন ভাঙনের পাড়ে
শক্তি সামন্ত
শেষ পরিণতি
বাংলা জনপ্রিয় ধারাবাহিক প্রেমের উপন্যাস মন ভাঙনের পাড়ে ভাগ 12
[বার]
আনার সাথে ব্রেকাপ হয়েছে অনেকদিন হয়ে গেল প্রায় । আনার মুখ দেখতেও পছন্দ
করে না বিকু।তারপর কেউ কিছু বুঝতেই পারল না ,হঠাৎ করেই আনার বিয়ে হয়ে যায় একদিন।
আর এদিকে বিকুর একটা কেচ্ছা রটেছে ইদানিং।
এক বিবাহিত মহিলার সাথে তার নাকি এফেয়ার চলছে এসব ভেবে চিন্তে বিকুর মা একদিন রূপক ,
আর এমনই কিছু বন্ধু বান্ধব কে ডেকে পাঠায় ।রূপক তখন বাড়িতেই ছিল।
বিকুর জন্যে মেয়ে
দেখে বিয়ের ব্যাবস্থা করতে বলে বিকুর মা। তার কেচ্ছার কথা জিজ্ঞেস করলে বিকু শুধুই হাসে।
কিছু বলে না। আজকাল বিয়ের জন্যে উতলা হয়ে উঠেছে সে।গৌড় ঘটকের সাড়া পড়ে গেল পাড়ায়।
অনেক গুলি পাত্রী দেখা হল পছন্দ আর হয় না।
অবশেষে একটি পাত্রী দেখে যখন বিকুর মনে পছন্দ আর নাপছন্দের দোলাচল চলছে।তখনই দেব
আর লাল্টু বিকুকে বুঝিয়ে রাজি করানোর চেষ্টা করে চলেছে ।দেব আর লাল্টু এ পাড়ারই ছেলে
বলছে, "দেখ এর
থেকে ভাল মেয়ে আর পাবি না।"বিকু চুপ করে সিগারেটে টান দিচ্ছে।রূপক হয়রান!কিছুতেই বুঝতে
পারছে না কেনই বা তাকে এত জপানো হচ্ছে?
তারপরেও দু-তিন দিন পর বিয়ের দিন ঠিক হয়। এই সময় রূপক বার বার বিকুকে একই কথা জিজ্ঞেস
করেছে , "তোর পছন্দতো?" বিকু সব সময় এই প্রশ্নের জবাবে চুপ থেকেছে।কেন? সেকথা
রূপক বুঝে উঠতে পারে না। উজান দিল্লিতে আছে , বিকু ফোন করে আসতে বলেছে।
উজান জানিয়ে দিয়েছে সে আসতে পারবে না।
[বাংলা জনপ্রিয় ধারাবাহিক প্রেমের উপন্যাস মন ভাঙনের পাড়ে ভাগ 12]
বিকুর মনের হাবভাব যেন একটু অন্য রকম। কেন যে সে রাজি হল এই বিয়েতে! রূপকের মনে অদ্ভুত
ধন্ধ।সে চায়না এই বিয়েটা হোক । কিন্তু সবাই যখন রাজি তারই বা কি করার আছে ।
রূপক একটা কথা বোঝার চেষ্টা করে, যখন তারা পাত্রীর বাড়িতে প্রবেশ করেছিল একটা জবা ফুল
পড়ে থাকতে দেখেছিল তাদের ঘরের দরজায়। রূপক এটা ভালোমতো দেখেছে এবং সকলেই তারা ফুলটা
ডিঙ্গিয়েছে কিন্তু রূপক পাশ কাটিয়ে গেছে। তাহলে কি পাত্রী পক্ষ কোন জাদু টোনা করল। রূপক
জানে এইসব এই সময়ের উন্নত সমাজের মানুষও করে থাকে।
কিন্তু সেটা কি করে সফল হতে
পারে? অবিশ্বাস্য, ব্যাপার নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না ।আর
এর থেকেও সুন্দরি পাত্রী সে আগেও দেখেছে কিন্তু এমন একজন মেয়েকে সে পছন্দ করল কি ভাবে?
সে ভাবে এটা কি তার শুধু দূর্বল মনের ভাবনা? হতে পারে। রূপক একজন বিজ্ঞান মনষ্ক ছেলে হয়েও
এইসব কুসংস্কারের কথা ভাবছে কি ভাবে? আর ফুল পরে থাকাটা একটা কাকতালীয় ব্যাপারওতো হতে
পারে।তার বিরোধাভাস চিন্তা ভাবনা চলতে থাকে।
বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেল, রূপকের মনে কোথাও একটা নাখুশ, চোখের বালির মতো কির কির
করতে থাকল।তার আর কিছু করার নেই। সে একটু বেশিই উদাসীন ছিল তার বিয়েতে।সমস্ত দায়িত্ব
নিয়ে লাল্টু আর দেব তদারকি করতে থাকল। বাসরে অনেকেই আছে ইয়ার্কি ফাজলামি চলছে যেমনটা
হয়। অসহ্য বিরক্তিতে বাইরে বসে আছে রূপক। ভাবল বাড়ি চলে যাবে।চলে যাওয়াই ভালো।বাইরে
থেকে যতটা শুনতে পাচ্ছে লাল্টু, আর দেবের মাতামাতি।নববধু গোপাও লাল্টু আর দেবের সাথে
যে ভাবে যে ভাষায় কথা বার্তা চলছে ওদের, রূপকের আর সেখানে থাকতে ভাল লাগলো না ।
পালিয়ে এল।
মাত্র কয়েকদিন হয়েছে বিয়ের, বিকুকে খুব আপসেট লাগছে এই ক-দিন। জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলে
না। দেব আর লাল্টু তাতেও মশকরা করছে। এই দুটো ছেলেকে মোটেই সহ্য করতে পারে না রূপক।
ভিতরে ভিতরে রাগে ফুলতে থাকে রূপক, কিন্তু কি আর করা যাবে। রূপক অনুমান করে বিকুর মন
খুব একটা ভালো নেই। নিশ্চয় গোপার সাথে কোন সমস্যা হয়েছে।জিজ্ঞেস করলেই ভ্রু কুঁচকে বলে,
"কই! কিছু নাতো।" রূপককে খুব একটা পাত্তাও দেয়না ইদানীং।
বাংলা জনপ্রিয় ধারাবাহিক প্রেমের উপন্যাস মন ভাঙনের পাড়ে ভাগ 12]
মদের নেশাটাও আবার ধরেছে। বেশ
আনাড়ি ছেলে একবার যেটা মাথায় ঢুকে সেটাই করে।কেউ বুঝিয়ে উঠতে পারে না। সঠিকভাবে সব
কিছু না জানলেও তার মনে যে অশান্তির আগুন জ্বলছে সেটা ভালো মতোই বুঝতে পারছে রূপক।
কিছুদিন বাইরে কোথা থেকেও ঘুরে এলে মন একটু শান্তি পেতে পারে। এই ভেবেই রূপক বিকুকে
জপিয়ে ছিল, "চল না আমার সাথে ব্যাঙ্গলোর , ঘুরে আসবি?" কে জানে তার মনে কি ছিল!
সব কিছুই নিয়তি। তার ভাগ্যে অন্য কিছু অপেক্ষা করছিল।জীবনের গতি মানুষের ইচ্ছে মতো চলে
না।
কোথাও না কোথাও এক অদৃশ্য শক্তি মানুষের জীবনকে পরিচালনা করছেন তাঁর ইচ্ছে মতন।
আমাদের কারও তাতে কিছু করার থাকে না ।
রূপকের মনটাও বিষণ্ণ হয়ে আছে হাতের সামনে অনেক গুলি বই,পড়ায় মন বসছে না কিছুতেই।
তাকিয়ে আছে দূর দিগন্তের পানে বয়ে যাচ্ছে নদীর ধার। এ দেশ ছেড়ে কিছুতেই তার দীর্ঘদিনের
জন্যে যেতে ইচ্ছে হয় না।
এই নদী, বট, অশ্বত্থ, ক্লাবের আড্ডা, রক এসব ছেড়ে থাকা তার পক্ষে
সত্যিই অসম্ভব এক যন্ত্রণা। ক্লাবের দিক থেকে ঘুরে আসা যাক মনটা একটু ফ্রি হয় যদি।
ক্যারামের গুটি গুলো সাজাতে সাজাতে পটলা বলছে, " জানিস বিকুর সাথে ঝগড়া হয়েছে ওর
বউএর।" রূপক যেন চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, "কেন?"
একটু দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে পটলা বলল, "কথায় কথায় শুধু নাকি লাল্টুর কথা বলে।
"
"এই রে ,মানে?" কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও ভালো করে জিজ্ঞেস করে নিল রূপক।
এই পটলার কাছে পাড়ার অনেক লোকের অনেক গোপন কথা থাকে। বোর্ডে পাউডার ছড়াতে
ছড়াতে বলল, "গতকাল নাকি বিকু কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবে বলেছিল।ওর বৌ জিজ্ঞেস করেছিল,
লাল্টুও যদি যায় তাহলে যাবে সেই নিয়ে বিকু গাল-মন্দ করে।" রূপক কিছুটা বিরক্তির স্বরে বলল,
"আরে পাগল নাকি!
কি ধরনের মেয়েরে বাবা!" রূপক মনে মনে ভাবছে মেয়েটাকি মানসিক
বিকারগ্রস্ত কে জানে । অবশ্য এতে লাল্টু আর দেবেরও দোষ আছে তারা যে একপ্রকার চরিত্রহীন
সেটা রূপক ভালোমত জানে। কি দরকার ছিল বাসরে ঐ ভাবে বন্ধুর নববিবাহিতা বৌয়ের সাথে
ইয়ার্কি ফাজলামি করার।করলই বা তাবলে কি ঢলে পড়তে হবে। নিজের মনে মনেই রূপক
বলে উঠল 'ছিঃ।' এইভাবে দুটো জীবনই নষ্ট হবে।
পটলা হি হি করে হাসতে হাসতে আরও বলল, "ভেবে দেখ নতুন বউ যদি এই ভাবে বলে অন্যকারও
সাথে ঘুরতে যাবে ।তাহলে কার মাথার ঠিক থাকে!" এই দুপুর বেলায় আর কেউ নেই এই ক্লাব চত্তরে ।
শুধু তারা দু-জন আর গুটির ঠকাস ঠকাস আওয়াজ। রূপকের মনটা গভীর দুঃখে ডুবে যায়।বেচারা
বিকু আনার সাথেও এই ভাবেই ঝগড়া হয়ে সম্পর্কটা ভেঙ্গে গেল।
আবার বিয়ে করেও সে সম্পর্কের মধ্যেও চিড় ধরছে।কে জানে কি হবে!
পাড়ায় হৈ হৈ হচ্ছে রঙের উৎসবে মেতেছে সবাই। বিকুকে আজ খুশি খুশি লাগছে। বটতলার কাছে
সবাই একজোট হয়েছে।তারপর বোধিদের ঘরে চলল হোলি খেলতে।বিকুর প্রসন্নভাব দেখে রূপকের
মনে হল তাহলে বিকুর আর কোন সমস্যা নেই ছোটখাটো প্রব্লেমতো সব দম্পতির মধ্যেই হয়ে থাকে
আবার মিটেও যায়। বিকুরও তাই হয়েছে।অনেক তারিফ করল গোপার সম্মন্ধ্যে।রূপকের আর সে
চিন্তাটা রইল না।
অনেকবার অনেক ভাবেই সাহয্য করেছে বিকু রূপককে তাই তার কাছে ঋণ রয়েই
যায়।ছোট বেলার আবেগঘন দিন গুলি কি করে ভুলা যায়।তার প্রতি একটা কেমন মায়া পড়ে
আছে।প্রত্যেক বন্ধুত্বের মাঝেই এমন এক মায়ার টান থাকে।
প্রায় অনেকদিন হয়ে গেল রূপক চলে এসেছে ব্যাঙ্গলোরে। বর্ষার প্রারম্ভেই মৌসুমি বায়ুর প্রাবল্য
দেখা দিলেই এই অল্প-স্বল্প মেঘ, বৃষ্টি, রোদের খেলা দারুণ রোমানটিসিজম বয়ে আনে কর্নাটকে।
শহর ছেড়ে একটু দূরে ঘুরতে এসেছে সে। পাহাড়ের হাওয়ায় মন ভরে যায়।রূপকের চুল উড়ে
যাচ্ছে চোখ মুখ স্নিগ্ধ করে দিয়ে যাচ্ছে মাতাল হাওয়া আর বৃষ্টির ছিটে।
তখনও জানত না রূপক,
এমন খুশির হাওয়া একটা হাহাকার বয়ে নিয়ে আসবে কারও মৃত্যু সংবাদ। রিংটোন বাজছে পকেটে
এমন সুন্দর কুয়াশার মত বর্ষায় ভিজতে ভিজতে একটা গাছের ছায়ায় গিয়ে ফোনটা বের করল।স্ক্রিনে
নামটা ভেসে উঠছে 'উজান' কানে দিয়ে থ হয়ে বসে পড়ল সেখানেই।
বিকুর মা বুঝতে পেরে ছুটে এসে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে তখন, 'হায় আমার কি সর্বনাশ হয়ে
গেল।'
শক্ত পোক্ত শরীরটা ঝিমিয়ে পড়ছে।দাদা ছুটে এসে ধরতে যায় ,'ভাই তোর কি হল?' বিকু তার
হাত ফসকে ছুটে পালাচ্ছে সে বাঁচতে চায় না আর।তার নিজের বউ তাকে নয় অন্য কাউকে পছন্দ
করে। অন্য কারও সাথে......
এই নিয়েই ঝগড়াটা বেধেছিল ।কথায় কথায় লাল্টুর নাম তার মুখে মোটেই ভাল লাগেনি
তার।দু-কথা শুনিয়ে দিয়েছিল গোপাকে আর গোপাও তার জবাবে বলে দিয়েছিল তার মত ছেলেকে
সে করুণা করেছে বিয়ে করে।ব্যাস, অভিমানী আর আনাড়ি স্বভাবের বিকু খুব শান্ত মাথায় এক
ভয়ানক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।
এ জীবনের মায়া কাটিয়ে চলে যেতে চেয়েছে পর জন্মের খোঁজে।
তার দাদার ফোন পেয়ে যখন ডাক্তার এল । শরীরটা ঝিমোতে ঝিমোতে মুখ দিয়ে অজস্র ফেনা
বেরোতে লাগল।চোখ উলটে গেছে। যে হৃদয়ে পেলনা সে কারও
ভালবাসা দুঃখে ,অভিমানে, রাগে বিষিয়ে দিল নিজেই।এক প্যাগ মদ আর এক চুটকি বিষ তার
শরীরে শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে। হৃৎপিণ্ডের সমস্ত রক্ত নীল হয়ে গেছে।
চোখের সামনে ভেসে
উঠেছে আনার মুখটা,তার ফর্সা নরম গাল আর গোলাপি ঠোঁট।নদীর পাড়ে সেই প্রথম চুম খাওয়ার দৃশ্যটা।
ধীরে ধীরে নীল হতে হতে কালো অন্ধকার ছেয়ে যাচ্ছে চারপাশটা।না আর নেই বিকু। কান্নার রোল
পড়ে গেল। আর এত বড় ঘটনা যখন ঘটে গেল। ঘরের ভিতর চুপ করে বসে আছে গোপা চোখে
এতটুকুও জল নেই, নেই কোন অনুশোচনাও।
ফোনে উজানের মুখে এই সব কথা শুনে কেঁদে ফেলল রূপক।
চলবে... পর্ব ১৩ পড়ুন
ConversionConversion EmoticonEmoticon