ধারাবাহিক উপন্যাস মন ভাঙ্গনের পাড়ে episode 8

 

ধারাবাহিক_উপন্যাস_মন_ভাঙ্গনের_পাড়ে_episode_8


মন ভাঙ্গনের পাড়ে 

       শক্তি সামন্ত

ধারাবাহিক উপন্যাস মন ভাঙ্গনের পাড়ে episode 8

                          [আট]

রুপক এবং বন্ধুরা
  

অবশেষে ছুটি পাওয়া গেছে।কোথা দিয়েযে তিন মাস কেটে গেল বোঝায় গেল না।এই প্রবাস জীবন 
 ভালো লাগছে না রূপকের।কতদিন বাবা মাকে ছেড়ে আছে।দেখা হয়নি প্রিয় বন্ধুদের সাথে।প্রিয় 
শহরটাকে অনেক দিন পর আবার দেখতে পাবে দুচোখ ভরে।এইসব ভাবতে ভাবতে ট্রেনে চড়ে 
বসল রূপক।রেলের জানলা দিয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য বেশ ভালো লাগছে রূপকের। 
স্টেশনটাকে ফেলে রেখে এগিয়ে চলল ট্রেন। 

আম বাগান আর কালো মাটির ভুট্টা ক্ষেত পেরিয়ে।কৃষ্ণা,গোদাবরী, মহানদী আরও কত পাহাড় জঙ্গল 
নদী মাঠ পেরিয়ে এল।কাছাকাছি খড়গপুর স্টেশন। মনটা আনন্দে নেচে উঠল এইতো পৌঁছে গেছে 
সে নিজের দেশে।সবাই আবার বাংলায় কথা বলছে।তার প্রানের ভাষা। তার দু-কান যেন শান্তি পেল।

এখানে পৌঁছেই কেমন যেন অবাক লাগছে তার।কত কিছুই পালটে গেছে। দোকান দানি ঘরবাড়ি 
গজিয়ে উঠেছে অনেক গুলি।তিনদিনের ট্রেন জার্নির ধকল গেছে এবার একটু ঘুমের দরকার তার। 

আজ অনেক দিন পর রূপক ফিরে এসেছে।সবার মনেই খুশি।আবার হই হই আনন্দ উল্লাস। ক্লাবে 
যেতেই পটলার সাথে দেখা বলল,উজান নাকি লেডিস টেলার্স খুলেছে তিনজন কর্মচারিও 
রেখেছে।কিন্তু রূপককে জানাল না একবারও অথচ প্রায়ই ফোনে কথা হয়।

পটলা বলল,"চল দেখবি ।এখনতো বিকু,উজান,সোম,রন্টির ওখানেই আড্ডা ক্লাবে খুব একটা আসেই 
না।আর বিকুর কি কেস শুনেছিস?" 
রূপক কৌতূহল হয়ে জিজ্ঞেস করল, "কই? নাতো। কি ব্যাপার?" পটলা বিদ্রূপের হাসি হেসে বলল,
"চল না সব শুনতে পাবি।" সত্যিইতো এতো কথা জানবার আগ্রহ কখনই দেখায়নি সে ,তাহলে 
জানবে কি করে।ক্লাব থেকে কিছু দুরেই একটা আণ্ডার গ্রাউণ্ড ভাড়া নিয়েছে।দেখে খুব খুশি হল 
রূপক।তিনজন কাজ করছে পাশাপাশি এলাকার ছেলে। 

রূপককে দেখে ওরা হই হই করে উঠল। 
উজান একেবারে গলা জড়িয়ে ধরল রুপকের। বিকু বসে বসে হাসছে । সোম, রন্টি ইয়ার্কি ঠাট্টা 
করতে আরম্ভ করল।বেশ কিছুক্ষণ পর  উজান বলল, "চল চা খেয়ে আসি।" সবাই মিলে   
গনেশদার দোকানে চা খাচ্ছে। ডিজে মিউজিক শুনতে পেয়ে রূপক জিজ্ঞাসা করল, "কি হচ্ছে বলত?"
বৌদি জবাব দিল, "কালি পূজা হচ্ছে। তোমরা জান না?" 

রূপক বলল,"ওহ আচ্ছা।চল উজান একবার দেখে আসি।" রূপক চায়ের বিল পেমেন্ট  করে দিয়ে 
উঠে দাঁড়াল।নদীর ধারেই মন্দির সামনে বড় মাঠ ।অনেকগুলো স্টল লেগেছে মেলার মতো ভক্তদের 
ভিড়। এর আগেও বেশ কয়েকবার এসেছে রূপক। ওরা ভিড়ের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে ।রূপক আর 
উজান  ভিড় ঠেলে মন্দিরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। 

এমন সময় দু-তিন জন মেয়ের সাথে আনাকে 
দেখতে পেল রূপক।রূপক দূর থেকেই আনাকে ইশাড়া করে ডেকে উঠল, "এই আনা।" আনা চমকে  
ঘুরে তাকাল,হাসছে। রূপক আরও বলে উঠল, "পেছনে বিকু আসছে।" উজান রূপকের কাঁধ চেপে 
ধরে বাঁধা দেবে তখন দেরি হয়ে গেছে।
আনা যেন উগ্র চণ্ডীর রূপ ধারণ করল।চোয়াল লম্বা করে চোখ গোলগোল করে খেঁকিয়ে উঠল,"এক 
থাপ্পড় দেব জানোয়ার কোথাকার।"

শুনেই রূপক কেমন হয়ে গেল।এ রকম জবাব সে আশা করেনি হঠাৎ কি হয়ে গেল আনার।
উজান চাপা গলায় বলছে,"চুপ চুপ আরে বিকুর সাথে ঝগড়া হয়েছে।" খুব শান্ত গলায় রূপক বলছে ,
"আগে বলতে কি হয়েছিল? এত অপমান বাপের জন্মে সইনি।"  

তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে রাস্তার লাইট গুলো জ্বলে গেছে। বটতলার রকে বসে অপমানের বিষে 
এখনও জ্বলছে  রূপক। পাশে উজান।রূপকের মনে হচ্ছে যেন ঠাটিয়ে এক থাপ্পড় আনার কানের নিচে 
বাজিয়ে দেয়।কি করে এতটা অপমান করার সাহস পায়।কি এমন খারাপ কথা বলেছে সে? আনার  
সাথে তার ভালোই ব্যাবহার আছে।কি মিষ্টি করে রুপুদা ,রুপুদা বলে ডাক।আজ কোথায় গেল?  
কতবার সিনেমা দেখতে নিয়ে যাওয়ার বাইনা করেছিল।

গায়ে ঢলে পড়ত ।চাইলে সেসব সুযোগ 
নিতে পারত রূপক। কিন্তু না, তার রুচি এরকম  নয়।তার সম্মানের কথা ভেবেই তার থেকে 
দূরত্ব বজায় রেখেছিল।বিকুকেও পোয় পোয় করে মানা করেছিল, কিন্তু কে শুনে কার কথা। 
তারপর অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল বিকু। তাই আর মানা করতেও সাহস হয়নি যদি আঘাত 
পায়।কিন্তু আজ আনা যা করল তা মোটেও মেনে নেওয়া যায় না।লজ্জ্বায় অপমানে সিঁটিয়ে আছে 
রূপক। উজান তার কাঁধে হাত রেখে বলল,"মন খারাপ করিস না। আসলে বিকুর সাথে আনার ঝগড়া 
হয়ে গিয়েছিল।"
 
কিছুটা স্বাভাবিক হল রূপক, পটলা কি তাহলে সে কথায় বলছিল! বলল, "কি নিয়ে ঝগড়া হল?" 
উজান বলতে শুরু করল,"দোষ কিছুটা আমারও আছে।আসলে আনা একদিন ফেসবুকে একটা টিকটক
ভিডিও পোস্ট করে আর সেই ভিডিওটা আমি বিকুকে দেখায়। আর ভিডিওটা দেখে বিকু রেগে লাল হয়ে 
যায় । আনাকে যা ইচ্ছে কথা শুনায়।তুইতো ভাল মতো জানিস বিকু কতটা আনাড়ি ।

একবার 
রেগে গেলে কারও সাদ্ধি আছে তাকে থামায়। আর আনাও কিছু কম নয়। অশিক্ষিত, মুর্খ্, পাঁঠা 
বললে বিকু আরও রেগে যায়। সেদিন আনার বাড়িতে কেউ ছিল না । সেই সুযোগে সোম আর 
রণ্টিকে পাহারায়  রেখে বিকু একেবারে আনার বাড়িতে ঢুকে পড়ে।

আনার সাথে একপ্রকার মারামারিই শুরুই করে দেয়।তারপর চেপে ধরে আনাকে জবরদস্তি করতে 
থাকে আনার সাথে।আনা বাধা দিতে থাকে,বিকুকে বুঝিয়ে বার বার বারন করতে থাকে, 
 'তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?'  

কিন্তু সে শুনবে কেন? তার মাথায় জেদ চেপে গেছিল। এদিকে কোন ফাঁকে আনার বাবা এসে 
গেছিল সোম আর রন্টি বুঝতেই পারেনি। ফলে যা হওয়ার তাই হল। বিকু তড়িঘড়ি পালিয়েতো 
এল কিন্তু বিকুকে চিনতে পেরে গেছে। বিকুদের বাড়িতে গিয়ে আনার বাবা দাদার সাথে বিকুর 
বাবা দাদার সে কি ঝগড়া।" 

এবার হাসি পাচ্ছে রূপকের বিকুর মতো বেবকুফ কেউ আছে? 
বলল, "আনার বাবা যদি কেস করত কি অবস্থা হত ওর বলত?"
উজান সম্মতি জানিয়ে বলল,"সেটাই কে বোঝায় ওকে বল?" রূপক ভারি অবাক হয়ে বলল , 
"আরে তাছাড়া আনার সাথে এমনিতেইতো ফিজিক্যাল রিলেশন আছে ওর।জোর জবরদস্তি করার কি ছিল?" 
উজান ঠোঁট কুঁচকে বলল,"কে জানে?" 
 
রূপক চুপ করে দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যা তারা জ্বল জ্বল করছে।বট গাছের 
পাতা নাড়িয়ে দক্ষিণা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে।
   
বর্ষা এবার শুরুর দিকে একটু আগে হালকা ঝড় বৃষ্টি হয়েগেল , স্যাঁতস্যাঁতে ওয়েদার দুপুরে ভাত 
খাওয়ার পর রুপকের আর ঘুম ধরছে না। সে চলে আসে উজানের কারখানায়। কিছুক্ষণ টাইম পাশ তারপরে বাড়ি 
গিয়ে বই পড়া ছাড়া আর কি কাজ।উজান তার কারখানায় ব্যাস্ত থাকে আর বিকুও আজকাল 
বাবার চাপে দোকানে বসতে হয়।

 সন্ধ্যার পর আবার সেই উজানের কারখানায় বসে আছে রূপক 
এমন সময় বিতান এল কোলকাতা থেকে। রন্টির দাদা বিতান বয়সে রূপকের থেকে একটু বড় 
হলেও সহজেই মেশা যায়।কোলকাতায় একটা প্রিন্টিং প্রেসে চাকরী করে। হঠাৎ 
করে শরীর খারাপ হয়ে যাওয়ায় বাড়ি চলে এসেছে।বাসে বেশ কয়েকবার বমিও করেছে।রূপককে 
দেখে জিজ্ঞেস করল,"কিরে কবে এসেছিস?" 

রূপক বলল, "এইতো পরশু এলাম।"  
রূপক আরও বলল,"বাড়ি চলে যা বিশ্রাম নে।কাল সকালেই একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিবি।"বিতান 
সম্মতি জানিয়ে বলল,"হ্যাঁ, ডাক্তারতো দেখাতেই হবে। সম্ভবত জন্ডিস হয়ে গেছে।" বিতান চলে গেল। 
  
সকাল বেলায় আবার এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। বৃষ্টি হলে বিরক্ত লাগে রূপকের।কোথাও বেরতে পারা যায় 
না। ঝলমলে রোদ উঠেছে। মেঘ কেটে গেছে।বটতলায় এসে বসেছে।ছুটির দিনগুলো ফুরিয়ে যাচ্ছে 
কিভাবে।আবার চলে যেতে হবে সব ছেড়ে সুদূর কর্নাটকে।মন চায় না কিছুতেই। অনেকবার ভেবেছে 
একটা কিছু ব্যাবসা  করবে। বাবাও রাজি ছিল।কিন্তু কি করবে সে
 
বিষয়ে সে নিশ্চিত নয়।ব্যাবসা বললেই কি আর ব্যাবসা করা যায়, রিস্ক আছে যথেষ্ট । 
 তারচে বিদেশের চাকরীটাই ভালো।  এদিকে আবার সুনিতার কথা ভাবলেই মনটা কেমন 
মোচড় দেয় বুকের ভিতর। সে ভালোমতো জানে সুনিতাকে এজন্মে পাওয়া তার হবে না।ভাবলেই 
মনটা উদাস হয়ে যায়।ভিতর থেকে এক গভীর টান অনুভব করে। যেন কত জন্মের আপন। 
 
সুনিতাকে প্রথম দেখেছিল বকুল তলার স্কুলমাঠে।সেবার স্বাধীনতা দিবসের দিন ছোট ছোট ছেলেমেয়ে 
গুলোর নানা রকম অনুষ্ঠান ভালো লাগছিল রূপকের। আরও ভালো লাগছিল লাল ওড়না গলায় 
জড়ানো সুনিতাকে।শুধু অনুষ্ঠানের তদারকিই নয় একটা দেশাত্ববোধক  গানও গেয়েছিল সেদিন 
সুনিতা।সে কণ্ঠ সে সুর আজও রূপকের বুকে বাজে।

 তার ধূসর কাজল চোখের মায়ায় বার 
বার হারিয়ে যায়।এবছর উচ্চমাধ্যমিক দেবে সুনিতা।এই বটতলা দিয়েই তাকে স্কুলে যেতে  
হয়। শুধু এক ঝলক দেখার আশায় বসে থাকা এখানে। সাহস করে বলে উঠা আর হল না।
সেজন্যে বিকু আর উজানের গঞ্জনা শুনতে হয় তাকে। 

বিতান আসছে," কিরে বসে আছিস।"
"হ্যাঁ , কি আর করব!" রূপক জবাব দিল।
"চল একটু ঘুরে আসি।"
"কোথায় যাবি? তোর শরীর ঠিক আছে?"
   
" হ্যাঁ, ডাক্তার বলছে তেমন কিছু নয় । আপাতত ঠিক আছি।চল না।ওপাড়ার দিকে।  
পিঙ্কির সাথে একটু দেখা করে আসি।" 

"চল।" বলেই রূপক বিতানের বাইকে চড়ে বসল।রূপক জানে পিঙ্কি বিতানের গার্লফ্রেন্ড। 
শুধু রূপক নয় অনেকেই জানে।একসময় আনার সাথে পিঙ্কির আর বিতানের বন্ধুত্ব ভালোই 
ছিল। এখন আর নেই। এই আনার মাধ্যমেই পিঙ্কি আর বিতানের সম্পর্ক গড়ে উঠে। রূপক 
ভাবল ভালোই হল সুনিতাদের বাড়ীর কাছেই পিঙ্কির বাড়ি যদি এক নজর দেখা  হয়ে যায়। 
ভালো লাগবে তার।   
 
না, কারও সাথেই দেখা হল না। হতাশ হয়ে বিতান বলল,"চল আরও একটু ঘুরে আসি।" 
অনেকটাই এসে গেছে ওরা আর একটু গেলেই আনন্দপুর। ফিরতে হবে এবার।একটা জায়গায় 
ওরা থামল। দেখতে পেল জিন্স টপ পড়া একটা মেয়ে হেঁটে আসছে পিঠে ব্যাকপ্যাক।  

বয়েজ ছাঁট চুল।পাশ দিয়ে চলে গেল।স্কুল-গার্ল বলেই মনে হয়। রূপকের মনে হল মেয়েটা আড় 
চোখে দেখছিল ওদেরকে।কিছু দূর যাওয়ার পর ঘুরে তাকাচ্ছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। 
ব্যাপারটা বেশ কৌতূহলি লাগল ওদের কাছে।
ফিরতে ফিরতে বিতান বলল," তুই এক কাজ কর। 

সুনিতাকে জীবনে পাবি না। ওর একটু 
ঘ্যাম বেশি। তারচে এই মেয়েটার পেছনে লাইন মার পটে যাবে। আমি আছিতো সেটিং করে দেবো।" 
রূপক হাসতে হাসতে বলল, "ধুরর, কি যে বলিস।প্রেম কি নিজের ইচ্ছে মতো সৃষ্টি করা যায়।"  
"দেখেছিস কি?মেয়েটা হাসছিল।"

"হাসল বলেই কি সহজ লভ্য হয়ে যায়।"
রূপককে একটু ধমকের সুরে জ্ঞ্যান দিতে শুরু করল বিতান,"দেখ, সব সময় নেগেটিভ চিন্তা 
রাখিস কেন?বি পজিটিভ ইয়ার।" 

রূপক হাসতে  হাসতে সম্মতি দিলেও সে ভালো মতো জানে এভাবে হয় না। শুধু প্রেম করার 
জন্যেই কি প্রেম হয়!যেখানে আবেগ নেই সে সাজানো প্রেমের কোন মূল্যই নেই।শুধু একে 
অপরের কাছ থেকে নিজেদের খারাপ যাকিছু লুকিয়ে রাখা।আর ভালো যা কিছু বাড়িয়ে 
দেখানো। না,কোন সম্ভাবনা দেখছে না সে। তার মনটা শুধুই সুনিতার কথায় বলে। 
[কি হতে চলেছে রুপকের জীবনে ?সুনিতা কি ধরা দেবে তার প্রেমে ? জানতে পরের পর্ব পড়ুন।]
    পর্ব ৯            

 ************** 
Previous
Next Post »

এই ব্লগটি সন্ধান করুন