মন ভাঙনের পাড়ে
শক্তি সামন্ত
ভূমিকা
মন ভঙনের পাড়ে নিছকই প্রেমের গল্প নয়, কিংবা
যৌবনের আশা-নিরারাশা কিছু কথা।মানুষের জীবন
কিছুটা নদীর মতই বয়ে চলে। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে,
সুখ দুঃখের বাঁক পেরিয়ে মোহনার দিকে চলতে থাকে।
আর প্রতি বাঁকেই তাকে ভাঙনের সম্মুখিন হতে
হয়। আবার নদী তার নিজস্ব গতি তৈরি করে অন্য
খাতে বয়ে যায়, মোহনায় মিশে। নতুবা অন্য নদীতে গিয়ে
পড়ে। মানুষের জীবনেও বাঁকে, বাঁকে প্রেম ভালবাসা
মিলে আবার ভেঙ্গে যায় মন । তবুও তাকে চলতে হয়
নয়তো বা শুকনো মরুর বুকে থেমে যেতে হয়। সেভাবেই
এখানে চারজন যুবকের প্রেম ভালবাসা আর বেকারত্বের
বাস্তবতা কল্পনার রঙে রাঙিয়ে তুলার চেষ্টা
করা হয়েছে। চার বন্ধুর কৈশোর উত্তির্ণ যৌবনের চাকরির
খোঁজের মাঝেই প্রেমে পড়া । এবং নানান
টানাপড়েনে তাদের জীবন এগিয়ে চলে এক অনিশ্চয়তার দিকে।
প্রথম পর্ব
এই গরমে বাইরে বেরনোর উপায় নেই। আজ যেন গাছের পাতা ঝলসানো গরম। দুপুরের
ভাত ঘুমের জন্যে ঘরে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়ে দিল উজান। নিজের অজান্তেই যেন কখন স্মার্ট
ফোনের স্ক্রিনে আঙুল চলে যায় তার। ফেসবুকে লগইন দিল, আজকাল ভার্চুয়াল বেশ
কয়েকটি মেয়ে বন্ধু হয়েছে উজানের তার বানানো মীম দারুণ ভাইরাল হয়।আর তাদের সাথে চ্যাট করে
অনেকটা টাইম কেটে যায়। শুধু ভার্চুয়াল'ই নয় বাস্তবেও দু-তিনটি বান্ধবী রয়েছে তার। অবশ্য ,এই
পাড়ার'ই। ক্রল করতেই চমকে উঠল একেবারে চোখ ঝলসানো আগুন-নৃত্য আনার।একটা
টীকটক ভিডিও আপলোড দিয়েছে ফেসবুক পোস্টে,অনামিকা পাল আনা।প্রচুর লাইক আর খারাপ খারাপ সব
কমেন্ট বিকু দেখলে নিশ্চয় রাগে লাল হয়ে যাবে। মনে মনে হাসি পাচ্ছে উজানের।
বিকুর কথা ভেবে কষ্টও হচ্ছে।হ্যাঁ , আনা তার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু বিকুর গার্লফ্রেণ্ড ।
ভিডিওটা বেশ কয়েকবার দেখল। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে।
হাত অবশ হয়ে ফোনটা খসে পড়ল বুকের উপর। তারপর বিছানার পাশে পড়েই রইল তুলে
সরিয়ে রাখার ইচ্ছেও হল না আর। তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। শুধু পাখার সাঁই সাঁই
আওয়াজ আসছে কানে।
বাইরে অনিমার খিল খিল হাসিতে জেগে উঠে উজান। ঘুমিয়ে পড়েছিল!বিকেল হয়ে গেছে।
ঢুলু ঢুলু চোখে বাইরে এল সে। কখন বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে!বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। বাড়ির
বাইরের মাটি ভিজে আছে। গাছ-পালাও ভিজে ভিজে লাগছে।দুচোখে বিস্ময় দেখছে উজান।
হঠাৎ করেই আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়ে গেছে ।
"আরে,উজানদা ঘুমিয়ে চোখ মুখ ফুলে গেছেতো।" বলেই খিল খিল হাসি।
একটু লজ্জ্বা পেয়ে উজান বলল, "ধ্যাৎ, যা চেঁচামেচি শুরু করেছিস ঘুমটা ভেঙ্গে গেল।"
"ওঃ বাব্বা আর কত ঘুমবে?" বিরক্তির ভঙ্গিতে বলে উঠল অনিমা।
অনিমা তার খুড়তুতো বোন তিন-চারটে বাড়ি ছেড়ে বড় একটা পুকুরের পাড়ে তাদের বাড়ি।
এই অনিমাদের বাড়ীতেই সারার সাথে পরিচয়।সারা ছাড়াও রিঙ্কি,রিমা,ডোরাদের সাথেও বন্ধুত্ব
হয়।ডোরাদের বাড়িতেও বেশ আড্ডা দেয় উজান।বেশ বড় বাড়ী ডোরাদের। পেছনে বাগান
বিভিন্ন ফলের গাছ। থাকার মধ্যে স্রেফ তিনজন। বাবা-মা আর ডোরা।এত বড় বাড়িটা
খালিই পড়ে থাকে। সারা,রিঙ্কি অনিমারা এলেই যেন ভরে উঠে সমস্ত বাড়িটা। ডোরার
বাবা,মা দু-জনেই স্কুল টিচার।ডোরাদের ফুটবল মাঠের মত বড় ছাদটাও একটা আস্ত ফুলের
বাগান।সেখানে অনেক সব বিদেশি ফুল ফুটে থাকে সারা বছর।সারা এলেই এই ফুলগুলোতে
হাত বুলোয় আর গন্ধ শুকে। চিলে কোঠার খোপে অনেক গুলো পায়রাও আছে। সাদা রঙের
বেশ কয়েকটা ধূসর আর কয়েকটা বাদামি-সাদা। সারা পায়রা খুব ভালবাসে।
মাঝে মাঝে পয়রা গুলোকে ধরে আকাশে উড়িয়ে দেয় আর মনের খুশিতে হাসি মুখে সেদিকে
তাকিয়ে যেন স্বাধীনতার স্বাদ নেয়।ডোরা রিঙ্কিরা তার কাণ্ড দেখে হাসতে থাকে।আজ
ডোরাদের ছাদে পায়রার বাসায় জল ঢুকে গেছে। টিন দিয়ে উপরটা ঢাকা দিতে হবে তাই
উজান কে ডাকতে এসেছে অনিমা। ডোরার মা পারুল কাকিমা নিজেই ডেকে পাঠিয়েছে।
পারুল কাকিমাও ফরমাশ খাটার একজন লোক পেয়েছে।টুকটাক ছোটখাটো কাজ থাকলেই
উজানের ডাক পড়ে যায়। পারুল কাকিমা সাদামাটা জীবন যাপন করেন। সবার সাথেই
খুব সাধারণ ভাবে মিশে। আর উজানকে একটু বেশিই ভালবাসে নিজের ছেলের মতো।আর
অনিমা, রিঙ্কিরাতো নিজের ঘরের মতোই মনে করে এখানে আসে। পারুল কাকিমা কখনই
বিরক্ত হন না।তবে হ্যাঁ, বেশি উৎপাত করলেই বোকা-ঝোকা করে।
এখনো দিনের আলো সম্পূর্ণ অন্ধকারে ঢেকে যায়নি। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে।ঝরঝরে
ওয়েদার ।ছাতা নিয়ে বেরোবার দরকার নেই। রাস্তায় জল জমে আছে একটু আধটু।
ডোরাদের বাড়ীতে ঢুকতেই উজান দেখতে পেল আগুন রঙের শাড়ী পড়ে নিতু বৌদি বসে
আছে সোফায়।তার ফর্সা মুখে উজ্জ্বল লাল সিঁথি লাল টিপ হালকা গোলাপি লিপস্টিক আর
শাড়ীটিও পড়েছে তেমন। একবারে আগুনের মতো রূপ।উজানকে দেখেই পাখির পালকের
মতো ভ্রু হালকা নাচালে বুকের ভিতর তোলপাড় করা এক অজানা ইশাড়া টের পায়
উজান।
বলল,"এইতো, কাকিমা আপনার ইঞ্জিনিয়ার এসে গেছে।" নিতু বৌদির সাথে আলাপ আছে
উজানের। একটু আধটু ইয়ার্কিও চলে। এই নিতু বৌদি পারুল কাকিমার গল্প করার সঙ্গী।
নিতু বৌদির সাথে সারাদের সাথেও গল্পগুজব ইয়ার্কি ফাজলামি হয়।উজান কিছু বলার
আগেই পাশে বসে থাকা পারুল কাকিমা বললেন, "এসেছিস, দেখনা বাবা ছাদে গিয়ে
একবার, নইলে আবার বৃষ্টি এলে পায়রা গুলো ভিজবে।"
"হ্যাঁ দেখছি কাকিমা।"
অনিমা আর ডোরার সহযোগিতায় পায়রার বাসা সারানো হয়ে গেল।মই থেকে নামল উজান।
অন্ধকার নেমে এসেছে পুকুরের জলে আম গাছের ছায়ায়।
"চল, আমি আসি তাহলে। সন্ধ্যে হয়ে গেল।"।
ছেলেদের মতো ছোট করে ছাঁটা চুল, চশমা পরে থাকা ডোরা আদূরে গলায় বলল,
" চা খেয়ে যাবে উজান দা।"
"আরে না।"
"মাকে তোমার ফেভারিট পকোড়া বানাতে বলেছি।চায়ের সাথে বেশ জমবে। কি এমন
কাজ আছে তোমার?" এমন সময় কল কল করে নিতু বৌদি কথা বলতে বলতে ছাদে
উঠে এল।
"এই উজান তোমার জন্যে একটা খবর ছিল।"
"হ্যাঁ বলো।" এক রাশ কৌতূহল নিয়ে সে বৌদির চোখে চোখ রাখল।তার চোখে চোখ
রেখে কথা বলার মতো কখনই সাহস হয় না উজানের।বেশ ডেসপারেট মেয়ে নিতু ।তার
নামে পাড়ায় অনেক কানাঘুষো গল্প শোনা যায়। থাকতেই পারে এমন সুন্দরি মেয়েদের
একটু আধটু গল্প না থাকলে সৌন্দর্যের মহিমা থাকে না।প্রেম করেই বিয়ে করেছে অনিমেষদা
কে।অনিমেষ দার সুপার মার্কেটে একটা কসমেটিকের দোকান। নিতু তার নিয়মিত
কাস্টমার ছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দোকানে গল্প করত,বেরোতই না।তার জন্যে সব
জিনিসেই এক স্পেশাল ডীস্কাউন্ট থাকত ।আর সে সুযোগ তার বান্ধবীরাও নিত কখনও
সখনও । নিতুবৌদিই মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে অনিমেষদাকে পটিয়েছে।এ কথা অবশ্য নিতুবৌদির মুখেই শুনেছে
উজান।
বিয়ের আগে নাকি বুলেট চালিয়ে অনিমেশদাকে পেছনে বসিয়ে কত প্রেম করেছে।একটি
মেয়ের বুলেট চালানো সহজ ব্যাপার নয় তার উপর আবার এই গ্রাম্য-মফস্বলে।
ডোরা অবাক হয়ে বৌদির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। অনিমার চোখে মুখে দুষ্টু হাসি।হয়ত
সে কিছুটা অনুমান করতে পারছে কি বলতে চাইছে নিতু বৌদি। "আরে, সারার ব্যাপারে।"
সারার কথা বলতেই কিশলয়ের মত নরম তাজা মেয়েটা চোখের সামনে ভেসে উঠল উজানের।
এইতো কালই দেখা হয়েছিল মেয়েটার সাথে।দিঘির জলের মতোই শান্ত তার মুখ ,প্রশস্ত
কপালে যেন পাখি উড়ে আসছে ডানা মেলে এমনই তার ভ্রু।পুরু ঠোঁটে কতইনা অভিমান
ভরা আছে যেন। ঘন কালো চুলে তার মন হারিয়ে যায়।
"এই উজান।" সম্বিৎ ফিরল উজানের নিতু বৌদির ডাকে।
"কি ভাবছ।"
"কিছুই না,কি বলো?"
" বলছিলাম যে ,সারাকে তোমার কেমন লাগে?"
"কেন ভালোই লাগে ।সারা আমার বন্ধুর মতো।"
"দেখো তোমাদের জুটি ভালোই জমবে বলো!" আসল কথাটা খুলে বলতে আটকাচ্ছে হয়ত নিতু
বৌদির।
" কি বলতে চাইছো বৌদি?"
"আসলে সারা তোমাকে না ...
"ওহ! কি হয়েছে সেটা বলবেতো?"
"সারা না, তোমাকে ভালবাসে।"
উজান এমনই কিছু আন্দাজ করেছিল।ডোরা আর অনিমা
ফিসফিস করে কিছু বলাবলি করছে।উজানের ভয়ে হাত পা অবশ হয়ে আসছে। বুকের
ভিতরটা ঢীব ঢীব করছে ।এইভাবে প্রপোজাল পাবে তাও আবার সারার কাছ থেকে কখনই
ভাবেনি।তার মতো মধ্যবিত্য পরিবারের ছেলে সারার সাথে প্রেম ভাবতেই পারছেনা।সারার
বাবা অনেক বড়লোক।হ্যাঁ বলতেও পারছে না, আবার নাও বলতে পারছে না উজান ।এর
আগে এমন কিছু ঘটেনি।তাছাড়া সারার মতো মেয়ের সাথে প্রেম করা ভাগ্যের ব্যাপার।এইবার
তার কান্না কান্না পাচ্ছে।কারন না বলতে চাইলেও তাকে 'না' বলতে বাধ্য হতে হবে।পরিস্থিতি
তার অনুকূল নয়। নিজেকে বড় অভাগা মনে হচ্ছে কেবল।
"কি অত ভাবছ উজানদা হ্যাঁ বলে দাও।" ডোরাকে এক অন্য ডোরা লাগছে এই মুহুর্ত্বে ও
এত উদগ্রীব কেন! তাহলে কি এটা ওদের চাল? বিস্ময়ে অবশ হয়ে আছে উজান।তিন জনেই
অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে ।তার হ্যাঁ শুনবার জন্যে। তার সম্মতি কিংবা অসম্মতি
জানার জন্যে কি থেমে আছে সময়!এখনো পুরোপুরি অন্ধকার নেমে আসছে না কেন?
যেখানে তার ভীরুতার লজ্জ্বা লুকিয়ে রাখতে পারবে।সেখান থেকে সরে এসে পুকুরের
জলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।পারের রডোডেনড্রন ফুল পাতা শাখা
হাওয়াই দুলছে। এইবার ফিরে তাকিয়ে উজান বলল,
"না বৌদি আমার পক্ষে এটা সম্ভব নয়। আমরা বন্ধু আছি ,বন্ধুই থাকতে চাই।"
বলেই সেখান থেকে একছুটে চলে এলো। অন্ধকার নেমে এসেছে ছাদের কোনায় কোনায়।
পায়রা গুলো খোপের ভিতরে নিঃশ্চুপ হয়ে আছে।মাঝে মাঝে গুটুর গুটুর করছে।
সবার মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে।তবুও ওরা তিন জন তখনও বলাবলি করছে,
"উজান কি রাগ করল!"
(চলব)
**************
(কি হতে চলেছে উজানের জীবনে ? উজান কি সারার ভালবাসায় সাড়া দেবে? সারা এই সব কথা জানতে পারলে কি রিয়াক্ট করবে??
জানতে হলে পরের পর্বের জন্যে অপেক্ষা করুন।)
ConversionConversion EmoticonEmoticon