প্রবৃত্তিশক্তি সামন্তস্নান সেরে চুলের জল ঝাড়তে ঝাড়তে আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কবির। সেভিং করলে মুখটা বেশ চকচক করে ।গালে ঠোঁটে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখছে।এমন সময় হঠাৎ সে দেখল, আয়নাতে তার অবয়বের ঠোঁট কেমন রুক্ষ হয়ে গেছে, কিন্তু বাস্তবিকই তার ঠোঁট'তো বেশ মোলায়েম।কি হচ্ছে!বেশ থতমত খেয়ে গেল সে।একি!দেখতে দেখতে তার দু সাইডের দুটি দাঁত ঠোঁটের বাইরে বের হয়ে এল। ঠিক কুকুরের যেমন দুটো দাঁত বড় হয়।সে আরও দেখল তার জীভ দেখতে দেখতে কেমন যেন লম্বা হয়ে বেরিয়ে ঝুলে পড়ছে।আর তা থেকে লালা ঝরছে টপ টপ করে।ভারি অবাক হয়ে গেল সে।একটু ভয়ও পেল, এমন অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড দেখে। হচ্ছেটা কি? ভালো করে চোখে মুখে হাত বুলিয়ে দেখল । নাহ, সবই'তো ঠিক আছে মানুষের মতোই তার চোখ,কান,নাক,জিভ,ত্বক। আবার ভালো করে আয়না তে দেখল।এ কি তারই প্রতিবিম্ব না কি অন্যকারও! ভয়ে ভয়ে পেছনে ফিরে তাকাল। না, কেউতো নেই। ভয়ে আয়নার কাছ থেকে সরে যেতে চাইল।কিন্তু কি ভেবে মনে সাহস জুগিয়ে আয়নার কাচটাতে হাত বুলোতে লাগল।এইবার আরও আশ্চর্য হয়ে গেল, ভয়ে সারা শরীর হিম হয়ে গেছে । প্রতিবিম্বটা তার মতো নড়ছে না , একটু স্থির হয়ে আছে যেন ।তারপর সে পরিস্কার বুঝতে পারল অবয়বটা ফুঁসছে ।যেন ভয়ংকর নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে এই বুঝি। এক লাফে সরে এল সেখান থেকে। জানলার কচের ভিতর দিয়ে তাকিয়ে দেখে পুরো শহরটা এখনও ব্যাস্ত হয়ে পড়েনি।কেমন যেন চুপচাপ। আকাশে পাংশুটে মেঘ ছেয়ে আছে। বড় রাস্তার পাশে ঝুপড়ী গুলো কালো ধোঁওয়ায় ঢেকে আছে। একবার মনে হল সে স্বপ্ন দেখছে না তো! নিজেকে চিমটি কেটে দেখবে? এমন সময় অনুমিতা কিচেন থেকে ডাক দিল, "কবির?" অনুমিতাকে কি সে বলবে এইসব অদ্ভুতুড়ে কান্ডের কথা? না। সে বিশ্বাস করবে না।উলটে ঝাড় দেবে,চোখে আগুন জ্বেলে বড় বড় করে বলবে, কাল রাতের নেশাটা বুঝি এখনও কাটেনি?কবির ভালো মতোই জানে অনুমিতাকে।কবির সব সহ্য করবে কিন্তু নেশা তুলে খোঁটা দিলে তার মাথা গরম হয়ে যায়।প্রতিদিন তার একটু মদ না হলে চলে না । কবিরের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। চুপি চুপি রান্নায় ব্যাস্ত অনুমিতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘসে আদূরে গলায় বলল,"কেমন লাগছে আমাকে ডার্লিং।" অনুমিতা একঝটকায় কবিরকে ছাড়িয়ে দিয়ে দুষ্টু হাসি হেসে নাকটা খামছে ধরে বলল,"দিব্বি হ্যান্ডু লাগছে রোজকার মতোই, বেশি ঢং করে লাভ নেই , দেরি হয়ে যাচ্ছে অফিসে যেতে হবে, বুঝলেন স্যার, চলুন এইবার। " চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কবির, যাকগে নিশ্চিত হওয়া গেল।এতক্ষণ যা ঘটেছে সবই মনের ভূল। কাল রাতে একটু বেশিই হয়ে গেছিল। কবির নিজের মনে নিজেই বলে উঠল,"কবির , নেশাটা এবার একটু কমাতেই হবে। হুঁহুঁ, নইলে সমস্যা আছে বস!" অফিসে বেরোবার আগে আর একবার আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। না সব কিছুই স্বাভাবিক আগের মতোই কোন শ্বাপদের নখ-দন্ত সে দেখতে পাচ্ছে না। ভীড় ঠাসাঠাসি বাসটা তার সামনে এসে দাঁড়াল। কন্ডাক্টর টেনে তুলে নিল। গুঁতো খেতে খেতে একেবারে বাসের মাঝখানটাতে এসে দাঁড়াল। এতো গুলো লোকের ঘামের বোঁটকা গন্ধ পেরিয়ে সে এক সুন্দরী মহিলার পাশে এসে দাঁড়াল। আহা! বেশ সুগন্ধে তার মন জুড়িয়ে যাচ্ছে, তেমনই পেলব শরীর মাখনের মতো দিব্বি উপভোগ্য।কবির ভীড়ের সুযোগ নিয়ে আরও একটু ঘেঁসে দাঁড়িয়েছে।বিরক্ত-সূচক দৃষ্টি নিয়ে কবিরের মুখের দিকে একবার তাকাল মহিলাটি। কবিরের চোখে মুখে প্রসন্নতা দেখলে বোঝা যায় যেন চাঁদের পাহাড় জিতে নিয়েছে। এমন ভিড়ের মধ্যে কবিরের হাত বেশ সন্তর্পনে কি দারুণ সুকৌশলে এইসব অসহায় নারী শরীরে খেলে বেড়ায়। তের থেকে তেতাল্লিশ যেকোন মেয়ের'ই। এ তার এক দারুণ অভিজ্ঞতা ।এই কৌশল তার জন্মগত শিক্ষা, ভগবানের দান এমনই দাবি করত সে স্কুলের বন্ধুবান্ধবের কাছে। কিন্তু আজ তার সে হাত থেমে যাচ্ছে। নিজেকে জানোয়ার মনে হচ্ছে। সেই সকালের আয়নার প্রতিবিম্বটা মনে ভেসে উঠছে। ঘটনাটা ঘটেছিল কাল বাড়ি ফেরার সময় যথারীতি ভিড় বাস ছিল । একটা সিট'ও পেয়ে গেছিল বেশ আরাম করে বসেছে।এমন সময় এক অল্প বয়সি মেয়ে ঠিক পনের ষোল বছর বয়স হবে হয়ত।তার চোখে মুখে এক অদ্ভুত দ্যুতি।মানুষ বলে মনে হল না কবিরের। ঠিক যেন দেবী,কিংবা পরি বলতে যা বোঝায়, শুধু ডানা থাকলেই হল। তার রূপে ঝলসে যাবে যেকোন পুরুষ'ই। সব থেকে আকর্ষনীয় যেটা, তার চোখের মনি এক অলিক রঙ বিশিষ্ট। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার কেউ'তো মেয়েটার দিকে তেমন তাকিয়ে দেখছে না।কিন্তু, অদ্ভুত ভাবেই সম্মোহিত হয়ে পড়ল কবির মেয়েটার প্রতি। এমন সময় শাপে বর হল।যেমন প্রায় হয়ে থাকে কবিরের সাথে। কবিরের এই এক মেয়ে ভাগ্য। মেয়েরা যেন কবিরের প্রতি আকর্ষিত হয়ে চলে আসে। আজও যেন তাই হল । মেয়েটা মৃদুস্বরে বলল, "একটু বসতে দেবেন?" এমন লাস্যময়ী, সুচারু মেয়েকে কি না বলা যায় । না! কবিরও না বলতে পারল না,"ওহ সিওর।" [প্রেমের গল্প] মেয়েটাকে বসতে দিয়ে উঠে দাঁড়াল কবির।প্রায় রোজই'তো তাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আসা-যাওয়া করতে হয়। আজও না হয় দাঁড়িয়ে'ই যাবে। কথায় বলে না,ঐ 'কিছু লোকের মরলেও স্বভাব যায় না।' কবিরেরও তাই অবস্থা তার হাত মেয়েটির শরীর দখল নিতে উদ্যত।প্রথমে মেয়েটা এই ভাবেই এক প্রকার বিরক্তি প্রকাশ করল। তাতেও থামল না কবির সুযোগ বুঝেই মেয়েটার ডান পাশের বুকটা চেপে ধরল। সটান খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মেয়েটা। তার অগ্নি বর্ষা দু-চোখ। কবিরের একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে যেন ফণা তুলে শঙ্খচূড়ের মতো নাগিন।ভয়ে পিলে চমকে গেল কবিরের। কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে কবির। মেয়েটা যেন শূন্যে ফণা ছুঁড়ার মতো করেই "জানোয়ার" বলে যে অদৃশ্য গরল ঢেল দিল তার জীবনে।তার পর থেকেই নিজেকে শ্বাপদের মতোই মনে হতে লাগল।সবাই কবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।তার বেশ একটু অপমান বোধ জাগল ।মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছে। বেশি কিছু ঘটবার আগেই নির্দিষ্ট স্টপেজের আগেই নেমে পড়েছিল কবির।বাকি রাস্তাটা হেঁটে হেঁটেই বাড়ী ফিরেছে । মেজাজটা বিগড়ে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে অনেকটাই মদ খেয়ে নিয়েছিল কবির।নিজের মনেই বলে ,"হুঁ! শালা তোর মতো কত .....।" আজ এই মুহুর্ত্বে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটিকে একটু সম্মান জনক চোখেই দেখছে।কিন্তু ভেতরের জানোয়ার তাকে অতিষ্ট করে তুলছে।তার ভিতরের জানোয়ার আর বিবেক যেন রণঝটাপট যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।তার প্রবৃত্তি তাকে দিয়ে অপকর্ম করিয়ে নিতে চাচ্ছে, কিন্তু তার বিবেক তাকে বারবার বাধা দিচ্ছে। বাস থেকে নামতে যাবে, এমন সময় অন্য এক বয়স্ক ভদ্র মহিলা বলে উঠল, "জানোয়ার দেখতেও পায় না।পা'টা একেবারে......। " অফিসে ঢুকতেই রিমাদি অরুণিমাদিকে বলছে "জানিস আজ বাসে কি হয়েছে?এক একটা জানোয়ার সব...।" আর কিছু কথায় কবিরের কানে গেল না। সে বুঝতে পারল বাসে কি হয়েছে।সব মহিলাদের সাথেই কি এমন ঘটনা ঘটে! [প্রেমের গল্প] কিন্তু , সব থেকে ভয়ানক যে শব্দটা ঐ "জানোয়ার" রিমাদি নাই উচ্চারণ করতে পারত। তার মাথার মধ্যে অনুরণন হতে লাগল কেবল ঐ একটা শব্দ জানোয়ার। মাথার ঘিলু নাড়িয়ে দিচ্ছে।হাজার হাজার স্নায়ু তন্তুর ভিতর দিয়ে কি প্রবল বেগে যেন বিদ্যুৎ বয়ে যাচ্ছে। যেন ছিঁড়ে তছনছ হয়ে যাবে সব। না,অফিসে বেশিক্ষণ কাজে মন বসাতে পারল না। অসুস্থ বোধ করতে লাগল। ছুটি নিয়ে বেরিয়ে এল।ব্যাপার কি?বুঝতে না পেরে অফিসের সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। সে স্থির করল পায়ে হেঁটেই বাড়ী ফিরবে। ফুটপাথ ধরে হাঁটা শুরু করল।কিছুদূর হেঁটে আসার পর সে দেখল,একটা ডাস্টবিনের পাশে তিনটে কুকুর নিজেদের মধ্যে মারামারি লেগে যাচ্ছে।কবির দাঁড়িয়ে পড়েছিল।একটা কুকুর এতটাই হিংস্র হয়ে উঠেছে যে কবিরের আয়নার প্রতিবিম্বটার কথা মনে হতে লাগল। একেবারে নেকড়ের মতো দাঁত বের করে ফুঁসছে।কবির যেন ওদের ভাষা বুঝতে পারছে। সব থেকে হিংস্র হয়ে উঠা কুকুরটা যেন আড়চোখে কবিরকে একবার দেখে নিল।গা কাঁটা দিয়ে উঠল কবিরের। আরে হচ্ছেটা কি?কুকুরটা কি তাকে তাদের স্বজাতি ভাবছে! কবির আর এক মুহুর্ত্ব দেরি না করে সেখান থেকে পালিয়ে এল। ঘরে ফিরে সোফায় এলিয়ে দিল। শরীরটা ভাল লাগছে না মোটেই। চোখ বন্ধ করে আছে। সব কিছু ভুলে যেতে চাইল।[প্রেমের গল্প] অনুমিতা ছুটে এল "কি ব্যাপার আজ কি ছুটি?" "না পালিয়ে এসেছি। ঠিক ভালো লাগছেনা।" "তোমার কি অসুস্থ লাগছে?" "না।" "আচ্ছা জল নিয়ে আসছি"অনুমিতা জল আনতে গেলে কবির উঠে দাঁড়ায় ।তারপর ধীরে ধীরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আবছা হয়ে থাকা আয়নাটা হাত দিয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে আয়নায় ফুটে উঠা নিজের প্রতবিম্বের চোখে চোখ রাখলো। আশ্চর্য হয়ে কবির দেখতে লাগল , তার চোখের মনি অদ্ভুতভাবে বদলে যাচ্ছে।এবার সে আর ভয় পেল না ।চোখ আরও বড় বড় করে তাকাল। দেখতে দেখতেই সেই প্রতিবিম্বের চামড়া রুক্ষথেকে রুক্ষতর হয়ে যাচ্ছে।দাঁত-নখ জীভ বদলে গেল অদ্ভুত ভাবে।কবির বুঝতে পারছে তার ভেতরের জানোয়ার প্রবৃত্তি।চিনতে পারছে তার এই সুন্দর মুখের আড়ালে আর এক শ্বাপদ বাস করে। তার নখ-দন্ত থেকে ঝরে পড়ছে কামনা ,মুখের আদল থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারছে বাসনা গুলি, আর জীভ থেকে ঝরে পড়ছে লালসা। কবির স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কেঁদে ফেলল।সে কান্নার আওয়াজ ঘরের দেওয়াল,ছাদ ভেদ করে আকাশ-বাতাস যেন বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। রান্নাঘর থেকে জল নিয়ে এল অনুমিতা বলল, "কি গো ঐ ভাবে তুমি আঊউউউউঁ করে চেঁচিয়ে উঠলে কেন?" "তুমি ঠিক শুনেছ? অনুমিতা?" "হ্যাঁ তাই শুনলাম'তো।" কবিরের মুখে আর কোন কথা নেই।স্থির চোখে তাকিয়ে রইল অনুমিতার দিকে।বাইরেও কি দু-একটি কুকুর তখন আউউউউউউ করে চেঁচাচ্ছে!
|
ConversionConversion EmoticonEmoticon