ভাঙন
শক্তি সামন্ত
আজ অনেক দিন পর নদীর পাড়ে এসে নিজেকে খুব শান্ত মনে হচ্ছে ভালোলাগায় ভরে উঠছে মনটা। এই নদীর সাথে আমাদের আত্মার টান । খুব ছোট বেলা থেকেই এই নদীর চরে খেলা ধুলো করেই বেড়ে উঠেছি আমরা ।বিশেষ করে শীতকালে তেল মেখে রোদ পোহানো এবং স্নান। কয়েক জন বন্ধু মিলে জটলা করা ।প্রথম বার খুব ছোট, বাবা আমাকে শুশুক দেখতে নিয়ে এসেছিল । তারপর বহু দিন পাড়ার ছেলেরা মিলে এক সাথে বহুবার এসেছি ।দক্ষিণে বয়ে যাওয়া নদীটি ভাঙনের কারনে পাড় অনেকটা ধসে পড়েছে ইদানীং। আর বালির চর একটু উত্তরে সরে গেছে ।
আজ কেমন যেন মনটা পিছনের দিকে ছুটছে । ফেলে আসা দিন গুলি কেমন মায়াবী লাগছে । চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠছে সেই সব ঘটনা। এই শীত কালে আমাদের গ্রামে নদীর পাড়ে , ডিসেম্বরে ,জানুয়ারি মাসে বহু মানুষ পিকনিক করতে আসে ।এক কথায় সুন্দর এক পিকনিক স্পট । আমরাও যদিও হাঁড়ি কড়া নিয়ে এসেছি ।আজ সারাদিন নদীর চরে চড়ুই ভাতি।বেশ খুশ মেজাজি মন ।আমি একা একাই আনমনে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলাম । পাড়ের জমি গুলো হলুদে ভরে উঠেছে সর্ষে ফুলে । আমি ফুলে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আল পথে।
আরও পড়ুন
একটু এগোতেই কয়েক জন মেয়ে পাড়ে বসে জটলা করছে । একজন আমার দিকে ফিরে তাকাল। "আরে সোমু না!" চমকে উঠলাম, কে এই মহিলা আমার ডাক নাম ধরে ডাকছে? যে নামে মা ছাড়া আর অন্য কেউ ডাকে না। হ্যাঁ , সেই টোল পড়া গাল ,টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো নাক, স্থির জলে ভাসমান পদ্মের মতো বড় বড় দুটি চোখ না চিনে কি পারা যায়। বেশ কয়েক বছর আগের আমদের টিয়াবনি গ্রামের সব যুবকদের বুকে ঝড় তোলা সেই অবাধ্য এক ঝর্ণা। আমার খুব কাছের রুনুদি । হ্যাঁ আমি ওকে রুনুদি বলেই ডাকতাম ।
আমার কোন দিদি নেই। মা এর কাছে প্রায় আসতো কাকিমা ,কাকিমা বলে একদম রান্না ঘরে ঢুকে যেত। আসলে আমিই একমাত্র জানতাম যে রুনুদি আসলে দাদার জন্যেই আসে।বিশেষ করে বই চাইবার অজুহাতে দাদার পড়ার ঘরে গিয়ে দীর্ঘ গল্পে মেতে যেত।
আমি কখনও ওদের কাছা কাছি চলে গেলে । দাদা চোখ পাকিয়ে বলত, "এখান থেকে যা।" আর রুনুদি মুচকি মুচকি হাসত। রুনুদি যে দাদা কে ভীষণ পছন্দ করত সে বিষয়ে আমার মনে কোন সন্দেহ ছিল না ।আসলে রুনুদি যতই সুন্দরী হোক না কেন দাদাও কম হ্যান্ডসাম নয় । ঋত্বিক রোশনের মত সিক্স প্যাক, তেমনি লম্বা চওড়া অনেক মেয়েই তার জন্যে ফিদা হয়ে যায়।
কখনো কখনো দেখতাম আড়াল থেকে, তাদের গল্প করতে করতে ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকে যেত ,আর দাদার হাত রুনুদির সারা শরীর ঘোরা ফেরা করত।দাদা ব্রিলিয়াণ্ট ছাত্র ছিল স্কুলের প্রতিটা ক্লাসে ফার্স্ট হত ।সেই সুবাদে সকলেই আমাকে সুরজের ভাই বলেই চিনত।ক্রিকেটেও অল রাউন্ডার।যদিও ফার্স্ট বোলার হিসাবেই দাদার নাম দূর -দূর গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল ।কোন বিষয়েই দাদার কোন ট্যালেন্টের কমি ছিল না।
শুধু দুটো বিষয়ে দাদার বদগুণ ছিন । প্রথম, দাদার ভালো রেজাল্ট হওয়া। তার মতো রেজালট না হলেই বাবা কথা শুনাতে কম করত না। এটা আমার কাছে দাদার বদগুণ মনে হত। দাদার মতো রেজাল্ট করতে হবে ।পড়া শুনায় মোটেই ভালো ছিলাম না আমি । দ্বিতীয়, যখন তখন দাদা চোখ পাকিয়ে আমি যে ছোট তা অনুভব করিয়ে দিত । আর মনে মনে ভাবতাম কবে বড় হব।
রুনুদিকে বাবা খুব একটা পচ্ছন্দ করত না । সেই নিয়ে মায়ের সাথে বাবার বেশ কয়েক বার রাগারাগি ও হয়েছিল। আসলে পাড়ায় রুনুদির একটা বদনাম ছিল তার নাকি অনেক ছেলের সাথে মেলামেশা । এটাই স্বাভাবিক এক জন সুন্দরী মেয়ের পিছনে কত-শত ছেলেই ঘুর ঘুর করে। তাই রুনুদির জীবনেও এমন অনেক কথা প্রচলিত থাকতেই পারে । এটাই স্বাভাবিক ।এতে রুনুদির দোষ দেখি না কখনই। যেটা বাবার একদম অপছন্দ ছিল।কিন্তু দাদার আর রুনুদির যে প্রেম কতটা গভীর সেটা সম্ভবত তৃতীয় আমিই জানতাম।আমিও চাইতাম যে রুনু দি আমার বউদি হলে মন্দ হবে না ।মাঝে মাঝেই রুনুদির স্নেহ ভরা হাত আমার অজয় দেবগনের মতো রাখা চুল ঘেঁটে দিত। আর খিল খিল করে হেসে উঠত। আমারও বেশ ভালো লাগত।সে হাসির কলরোল হৃদয়ের গভীর অনুভূতিতে আঘাত করে যে তরঙ্গ তুলত তা আজও অনুভব কতে পারি।
কিন্তু সব সম্পর্কই বিধাতার হাতে লেখা থাকে ।এ ক্ষেত্রে বাবার উপরেই নির্ভর করছিল। আর তাই হল। বাবার একগুয়েমির ফলে সেটা আর সম্ভব হল না ।রুনুদির অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেল ।রুনুদি নিমন্ত্রণ করে গিয়ে ছিল কিন্তু আমাদের বাড়ি থেকে কেউ গেলাম না । আর কেমন যেন চরম অভিমানে আমিও সব কিছু ভুলে যেতে চাইলাম । দাদার তো আরও বেশি কষ্ট ।কখনো বুঝতে পারিনি । দাদাও মুখ ফুটে কখনো তা প্রকাশ করেনি । রুনুদি একবার একটা মাফলার বুনে দিয়েছিল দাদাকে ।বহু দিন সেই মাফলার দাদা গলায় জড়িয়ে এই শিতের বিকেল গুলো ক্রিকেট মাঠে কাটিয়ে ছিল ।আমার খুব মনে পড়ে দাদা গর্ব করে বলত এই মাফলার নিয়ে সে খেলতে গেলে কোন ম্যাচ হারবে না । আসলে আমি জানতাম সেই মাফলারে রুনুদির ভালোবাসা ছিল।
দাদা বলত, ' এই ভালবাসা একদিকে আর সারা পৃথিবী এক দিকে।' রুনুদি বলেছিল ,'দেখো এই ভালবাসার কাছে সব বাঁধা ভেঙ্গে চুরচুর হয়ে যাবে।' আমিই জানি বাবার একগুঁয়েমির কাছে সেই ভালবাসা মুখ থুবড়ে পড়েছিল।
তার পর রুনুদির বিয়ের পরে দাদা কেমন মন মরা হয়ে যায় খেলা ধুলো ছেড়ে দেয় ।দাদা এখন প্রাইমারি স্কুলে চাকরী করে।অথচ দাদার অনেক বড় ক্রিকেটার হওয়ার কথা ছিল।আর সেই মাফলার আলমারির ভিতরে রেখে দিয়েছে দাদা ।আর কখনও দাদাকে মাথায় দিতে দেখিনি। ভীষণ মন মরা হয়ে থাকে সব সময় । দাদা কখন ও বিয়ে করবে না বলে পণ নিয়েছে । রুনুদির জন্যে ।
সেই রুনুদি কে আজ কয়েক বছর পর দেখছি এক অজানা আনন্দে ভরে উঠল মন।
এগিয়ে গিয়ে বললাম, "আরে রুনুদি তুমি কবে এসেছ?"
বলল এইতো,"আজ সকালেই।তুই কেমন আছিস?"
"আমি ভালো জানো মা সব সময় তোমার কথা বলে।এসো না আমাদের বাড়িতে।"
রুনুদি হাসি মুখে বলল, "হ্যাঁ সন্ধ্যের দিকে যাব।কাকিমা কেমন আছে? কাকু ?"
বললাম, "সবাই ভালোই আছি।তুমি কিন্তু আসবে সন্ধ্যার দিকে মা খুশি হবে।"
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখি মায়ের কাছে কাঁদছে রুনুদি । যতটুকু বুঝতে পারলাম ।রুনুদির স্বামীর সাথে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে ।এবং তা কোর্ট পর্যন্তও গড়িয়েছে ।নারী নির্যাতনের কেশে জেলে আছে রুনুদির স্বামী। মদ খেয়ে প্রতি রাতেই অত্যাচার করত । মনে মনে ভাবলাম রুনুদি তাহলে আর যাবেনা শ্বশুর বাড়ি।
বাবা ঘরে ফিরল এইমাত্র ।বাবাকে দেখে রুনুদি প্রণাম করল । না, আজ বাবাকে অখুশি হতে দেখলাম না ।হয়ত বাবা নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।রুনুদির মাথায় হাত দিয়ে বলল," ভালো আছিস মা।" রুনু দি চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, "হ্যাঁ কাকু , আপনি ভালো আছেন?" বাবা "হ্যাঁ" বলে ভিতরে চলে গেল। বাবা নিশ্চয় আগে থেকেই জানে রুনুদির ব্যাপারে।
আমিও একটু উদাস মনে নিজের রুমের দিকে চললাম। দাদার ঘরের পাশে এসে দেখলাম দাদা জানলার রড ধরে দূরে তাকিয়ে আছে। যেখানে চাঁদ উঠছে। দাদার মনেও অন্ধকার কাটিয়ে এমনই জ্যোৎস্না ঝরুক।
দুই]
আজ পৌষ সংক্রান্তি সকাল থেকেই নদীর ধারে আমাদের ভিড়। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ স্নান করতে এসেছিল। একটি ক্রিকেট ফাইনালম্যাচ ও আছে ।প্রতিবছর মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করি আমরা।নদীর পারে সব্জি ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে খেয়া ঘাটে যাওয়ার রাস্তার পাশেই আমদের খেলার মাঠ।
আমিও টিমে আছি ।কিন্তু আমি খুব একটা ভালো খেলতে পারিনা । আর আশ্চার্যের ব্যাপার হল দাদা যেই থেকে খেলা ছেড়েছে সেই থেকেই পর পর তিন বছর ফাইনালে উঠেও হেরে গেছি আমাদের টিয়াবনি গ্রাম। এ বছর জিততেই হবে আমাদের টিয়াবনি গ্রামের সম্মানের ব্যাপার।এই মাত্র বুড়ো দা এসে জানাল, "আরে তোর দাদা খেলবে বলছে।" আমি চমকে উঠলাম ,"কি বলছ গো!দাদা খেলবে বলছে হতেই পারে না!দাদা তো বহুদিন প্রাক্টিস নেই খেলবে কিকরে?"
বুড়ো দা দাঁত বার করে হাসতে হাসতে বলল, "আরে রুনু এসেছে না সেই জন্যেইতো ।কি বুঝলি?" আমি অবাক হয়ে গেলাম ।বুড়ো দা আরও বলল, "কাল বিকেলে অনেক সন্ধ্যা পর্যন্ত ওরা নদীর ধারে কি করছিল !"
বুড়ো দার অশ্লীল ভঙ্গিমায় যেটা বুঝলাম সেটা কি ঠিক? তাহলে কি?......
কিন্তু দাদার যেহেতু প্রাকটিস নেই অতএব দলে নেওয়ার প্রশ্নই নেই । শেষ মেষ একটা আলোচনায় বসা হল । আমাদের কোচ অনিমেষদা বলল, "যেহেতু তিন বছর তো হেরেই আসছি তাই সুরজকে একটা চান্স দিয়েই দেখা যাকনা!" সিদ্ধান্ত হল আমার জায়গায় দাদা খেলবে ।আমিও দাদার খুশির জন্যে চরম উৎসাহে সম্মতি জানালাম । দাদাকে বললাম, "ম্যাচটা তোকে জিততেই হবে দাদা, যেকোন প্রকারে।" দাদা মুচকি হাসল।
নির্দিষ্ট সময়ে ম্যাচ শুরু হয়েছে ।দেখলাম রুনুদিও পাড়ার মেয়েদের সাথে খেলা দেখতে এসেছে ।খেলা শুরুর আগে কিছু অনুষ্ঠান হয় ।রুনুদি এবং রুনুদির বোন শম্পা ও পাড়ার মেয়েরাও সেই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছে।আজ রুনুদি কে বেশ হাসি খুশি চঞ্চল দেখাচ্ছে। রুনুদির বোন শম্পা আমার দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। নাকের উপর ভারি চশমা বয়েজ কার্ট চূল আর জিন্স-টপ পড়া গম্ভীর স্বভাবের মেয়েটা আমার সাথে ততধিক কথাই বলে না।অথচ আজ তার হাসমুখ মেজাজ বেশ অবাক করে দিচ্ছে আমায়।এই শিতের দুপুরের নরম রোদ তার
গালে পড়ে এক অদ্ভুত গোলাপি-লাল হয়ে আছে।অবশেষে এক টান টান উত্তেজনায় খেলা শেষ মুহুর্ত্বে আর কয়েকটা বল বাকি আছে ।রানও খুব বেশি নেই যদিও । আমরা সবাই টেনশনে আছি কি হয় !কি হয় !রুনুদিকে দেখলাম হাত জোড় করে চোখ বন্ধ উর্ধ্বমুখে ঠাকুরকে ডাকছে। জানি রুনুদি দাদার জন্যেই......
লাস্ট দু-বল আর ছয় রান।খেলা নিয়ে আমি আর ভাবছি না , আবেগে আমার বুক ভারি হয়ে আসছে ।ভাবছি খেলাতো এমন বহু ম্যাচ খেলা যাবে কিন্তু দাদা আর রুনুদি কি এক হতে পারবে কোন দিন!চোখ ভিজে যাচ্ছে,আমি নদীর ধারে চলে এলাম ।মনটা খারাপ লাগছে।ওদিকে মাইকে প্রচার চলছে ।পর পর দুটি চার মেরে সুরজ টিয়াবনি গ্রামকে চ্যাম্পিয়ন করে দিয়েছে । ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ ট্রফি তুলে দেওয়া হচ্ছে সুরজের হাতে ………ইত্যাদি।
কিছুক্ষণ পর পিছন থেকে শম্পা ডাক দিল ও সোমু দা আমরা জিতে গেছি ।তুমি পালিয়ে এলে কেন? শম্পা আমার সাথে খুব একটা কথা বলে না ।আমিও তেমনি বলি না। কিন্তু আজ ও খুব যেচে কথা বলছে কেন কে জানে!
বললাম, "এমনি।" শম্পা বলল, "জানো আজ দিদি খুব খুশি হয়েছে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর থেকে তো কারও সাথেই তেমন কথাই বলত না।সুরজ দার সাথে দেখা
হওয়ার পর থেকে খুব খুশি খুশি ভাব দেখছি।" আমি কেমন যেন চমকে উঠে বললাম, "তাই?"
"হ্যাঁ গো ওই দেখো দিদিকে।" দেখি নদীর একদম জলের কাছে বালির উপর দাঁড়িয়ে আছে রুনুদি আর দাদা হাত ধরে অনেক কাছাকাছি ।আমরা কাশ বনের আড়ালে চলে এলাম যাতে আমাদের কে দেখতে না পায় ওরা ।
শম্পা আমার হাত চেপে ধরে আছে,ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, "চুপ।" এদিকে খেলার মাঠ থেকে মাইকে একটা গান ভেসে আসছে – "দো দিল মিল রাহি হ্যা মাগার চুপকে চুপকে..." হঠাৎ গান বন্ধ হয়ে গেল।শম্পা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। শিতের বেলা কখনযে ফুরিয়ে যায় বোঝায় যায় না। সন্ধ্যে হয় হয়।
তখনো ওরা নদীর চরে, দূর থেকে শুনতে পাচ্ছি রুনুদি গায়ছে "আজ ফির জিনে কি তামান্না হো ,কাল ফির………"
[ সমাপ্ত ]
ConversionConversion EmoticonEmoticon