ভুল স্টেশনে নেমে
(পর্ব- 36)
সমীরণ সরকার
------ আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিবি?
------ কি?
-------- এই জটিল বৃত্তের মধ্যে তুই নিজেকে জড়ালি কেন?
-------- না জড়িয়ে তো কোন উপায় ছিলন পলাশদা।
-------- মানে?
---------- তুমি তো জানো বাবা মারা যাবার পরে ঠাকুমা আমাদের কুসুমদোলা থেকে নিয়ে চলে যায় নিজের কাছে, আমাদের গ্রামের বাড়ীতে ।--
-----------সেটা কোথায় ?
-------হুগলি জেলার একটা ছোট্ট গ্রাম ভবানন্দপুর। ঐ গ্রামে আমাদের পৈত্রিক ভিটে, চোদ্দপুরুষের বাস।
দুদিকে দুটো ছোট নদী আর একদিকে মস্ত বিল দিয়ে ঘেরা ওই গ্রাম । বর্ষাকালে ওই নদী দুটো ফুলে ফেঁপে এমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতো যে গ্রাম থেকে বাইরে বেরোনো দুষ্কর হতো ।একটা নদীর উপরে বাঁশ আর খেজুর গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি ছিল অস্থায়ী সাঁকো। নড়বড়ে ওই সাঁকোর উপর বাঁশের রেলিং ধরে , জীবন হাতে নিয়ে বর্ষার দিনে গ্রাম থেকে বেরিয়ে বাইরে যেতে হোতো।
আমাদের গ্রামে মাছের কোন অভাব ছিল না ।কিন্তু দৈনন্দিনের প্রয়োজন বাকি যেকোনো জিনিস কিনতে হলে, গ্রাম থেকে বেরিয়ে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটে নবাবগঞ্জে যেতে হতো ।
আমার মায়ের পক্ষে সম্ভব ছিল না ওইভাবে সাঁকো পেরিয়ে পাঁচ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে নবাবগঞ্জে যাওয়া।
-------কেন, নবাবগঞ্জে কাকিমার যাওয়ার কি প্রয়োজন ছিল?
-------পেনশন তোলার জন্য।[ভুল স্টেশনে নেমে পূর্ববর্তী পর্ব গুলি পড়ুন]
------ কেন, ব্যাংক ছিল না তোদের ভবানন্দপুর গ্রামে?
----- কল্পনাই করা যায় না !সবচেয়ে কাছের ব্যাংক ছিল ওই নবাবগঞ্জ হাটতলায়। ফলে ব্যাংক থেকে পেনশন আনার জন্য মাকে নির্ভর করতে হত কাকাদের উপরে ।
-----তাতে সমস্যাটা কোথায়?
----- সমস্যা তেমন কিছু ছিলনা ,তবে-----
-----কি,বল ? আবার থেমে গেলি কেন?
------খুব খারাপ লাগছে বলতে,শত হলেও তো নিজের কাকা।
------ অসুবিধা থাকলে বলিস না।
-------- তোমাকে বলতে কোন অসুবিধা নেই । শুধু খারাপ লাগছে, এই যা ।
--------বেশ,বল তাহলে।
---------দুই কাকাই পেনশন তোলার পরে অনেক টাকা খরচা করতো নবাবগঞ্জের বাজারে। ------- মানে ?কিসে খরচ করত ?
---------কোন নির্দিষ্ট কিছু নয়, টুকটাক এটা সেটা।অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনত ।কাকার বাচ্চাদের জন্য দামি দামি খেলনা কিনে আনত।
------কাকিমা কিছু বলতেন না?
------ দু একবার মুখ খুলেছিল মা ।তাতে কাকিমারা খুব অশান্তি করত আর কাকারা ভয় দেখাতো পেনশন আনতে যাব না বলে।[ভুল স্টেশনে নেমে পূর্ববর্তী পর্ব গুলি পড়ুন]
-------- ভারী অদ্ভুত আচরণ তো!
------ হ্যাঁ ।অথচ মা কিন্তু পেনশনের প্রায় পুরো টাকাটাই ঠাকুমার হাতে তুলে দিতো ।
-----তোর ঠাকুমা কিছু বলতেন না ছেলেদের?
----- হ্যাঁ, ঠাকুরমা বলতো। অনেক বোঝাতো কাকাদের ।কিন্তু তাদের এক কথা ।
আমরা জমিতে চাষ করি।খেটে ফসল ফলাই। তবু সেই ফসলের ভাগ কি আমরা ওদের দিই না? তাহলে পেনশনের টাকা আমরা খরচ করতে পারব না কেন?
ঠাকুরমা বলতো, দুটো জিনিস এক নয়। যে জমি তোরা চাষ করিস ,তা আমার শশুর মশাই আর স্বামীর কেনা। আর নন্দিনী এই বংশের মেয়ে। ওর তো অধিকার আছে ওই জমিতে। মেজ কাকা একটু রগচটা ছিল ।সে রেগে গিয়ে বলতো ,দাদা যখন বিয়ে করে বউ নিয়ে দূরে চলে গেছিল ,তখন কি আমাদের কথা ভেবেছিলো?
ঠাকুমা বলতো, ওই কথা বলিস না মেজখোকা ।সে তো আজ আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছেব।লতে বলতে শাড়ির খুট দিয়ে চোখ মুছতো ঠাকুরমা ।[ভুল স্টেশনে নেমে পূর্ববর্তী পর্ব গুলি পড়ুন]
মেজ কাকা তখন একটু নরম হয়ে বলতো ,আমি কি এমন বললাম মা ,যে তুমি কাঁদতে শুরু করে দিলে ?
-----ও তুই বুঝবিনা মেজ খোকা ।তোরা যখন হাট বাজার করতে বা অন্য কোন কাজে নবাবগঞ্জে যাস, তখন বৌমার পেনশন টা তুলে এনে দিস ।শুধু ওটা আনার জন্য তো তোরা গঞ্জে যাস না ।তাছাড়া পেনশনের টাকার প্রায় পুরোটাই বৌমা আমার হাতে তুলে দেয়। আমিই তো সংসারের জন্য খরচা করি। তাহলে তোদের অসুবিধাটা কোথায়?
----- ঠিক আছে ঠিক আছে, আমি এনে দেবো পেনশন ।এক পয়সাও খরচা করব না ওখান থেকে ।
-----আহা ,তুই কি রাগ করলি রে মেজ খোকা ! কোন উত্তর না দিয়ে মেজ কাকা ঘরের ভিতরে ঢুকে যেত । মাঝে মাঝেই হতো এরকম।
-----তারপর?
----- ঠাকুরমা যতদিন বেঁচে ছিল, সত্যি কথা বলতে কি আমাদের তেমন অসুবিধা হয়নি ।ঠাকুরমা মারা যেতেই আমরা ভীষণ সমস্যায় পড়লাম। কাকা আর কাকিমাদের ব্যবহার দিন দিন খারাপ হচ্ছিল ।মনে হচ্ছিল আমরা যেন অবাঞ্ছিত ব্যক্তি ।বাধ্য হয়ে কুমারপুর এ বিশু মামার বাড়িতে গিয়ে উঠলাম আমরা ।
(চলবে)
ConversionConversion EmoticonEmoticon