ভুল স্টেশনে নেমে
সমীরণ সরকার
কিস্তি ৩২
খিদেটা এত জোর পেয়েছিল যে ,উপকরণ যত সামান্য হোক না কেন, পলাশ খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছিলো খাবারটা। নন্দিনী কখন যে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে তার পিছনে দাঁড়িয়েছে, পলাশ খেয়াল করেনি। চমক ভাঙলো নন্দিনীর কথায়, তোমার বোধহয় আরও কয়েকটা রুটি লাগতো ।তাই না পলাশদা?
------হ্যাঁ, না- মানে, আসলে খিদেটা খুব জোর লেগেছে তো, তাই আর কি।
----- খিদে লাগাটাই তো স্বাভাবিক। কালকে কোন সকালে বাড়ি থেকে খেয়ে বেরিয়েছো ।তারপর ট্রেনে কি খেয়েছ না খেয়েছো, তার ঠিক নেই ।ষ্টেশনে নেমে তো একা ভূতের মত বসে ছিলে । ওখানে কোন খাবার কিনে খাওয়ার ব্যাপারটা প্রায় অসম্ভব।আর তারপর তো আমার পাল্লায় পড়ে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এত দূরে এলে। কিন্তু বিশ্বাস কর পলাশদা, আমার ইচ্ছা থাকলেও কোন উপায় ছিল না। মানে ....
কথা বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে যায় নন্দিনী।
পলাশ খাওয়া থামিয়ে ওর মুখের দিকে তাকায়। ওর সারা মুখ জুড়ে কালো মেঘ।খুব অবাক হয় পলাশ । আরে,এইতো বেশ কথা বলছিল মেয়েটা।হঠাৎ কি হলো ওর?
খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় পলাশ। উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নন্দিনী।পলাশ হাত
দিয়ে জোর করে ওর মুখ ফেরায় নিজের দিকে। নন্দিনীর চোখ ছল ছল করছে ।এতক্ষণে খেয়াল করে পলাশ ,নন্দিনী কাল রাতের পোশাক পরিবর্তন করে একটা পিকক ব্লু রঙের শশ্বশাড়ি আর ম্যাচিং কালারের জামা পরেছে। অপূর্ব লাগছে ওকে। অনেক বছর আগে যখন সবে যৌবন উঁকি মারছিল নন্দিনীর দেহের চৌকাঠে ,তখন এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় পলাশ যেন নতুন করে আবিষ্কার করেছিল ওকে। কিন্তু
আজ এত বছর পরে যখন ওর সারা শরীর জুড়ে দু কূল ছাপানো বর্ষার নদীর মত যৌবন উথাল পাথাল করছে , তখন ওর চোখে জল কেন? তবে কি সত্যি আশ্রম মাতা ওকে ডেকে পাঠিয়ে এমন কিছু বলেছেন যে ,ও অপমানিত হয়েছে? পলাশ জিজ্ঞাসা করে, কিরে, কি হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন? আশ্রম মাতা কি তোকে অপমান করেছে?
কোন কথা না বলে জোরে জোরে ঘাড় নাড়ায় নন্দিনী। পলাশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, সত্যি কথা বলতো, কি হয়েছে তোর ?
----আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, তোমার নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে। তাই কমন কিচেনে গিয়ে এক্সট্রা খাবার চেয়েছিলাম, কিন্তু পাইনি ।ওরা বলল যে.....।
আবার চুপ করে যায় নন্দিনী।
--- কি হলো, আবার কথা বলতে বলতে চুপ করে গেলি কেন?
--- না, ও কিছু না ।
-----দেখ ,সত্যি কথা যদি না বলিস তো আমি আর খাব না।
---- এমন করোনা পলাশদা, প্লিজ!
--- তাহলে সত্যি কথা বল।
----বেশ বলছি ।আসলে এই আশ্রমে যতজন থাকে, প্রত্যেকের জন্য টিফিন, লাঞ্চ ,ডিনার বা অন্যান্য যেকোনো খাবার বা পানীয়,যা আশ্রমের তরফ থেকে দেওয়া হয়, তা তৈরি হয় ,একটা নির্দিষ্ট মাপে ।কাজেই বাড়তি খাবার কোন কারণেই দেওয়া হবে না, এটাই জানিয়েছিল ওরা আমাকে ।
------তার মানে,তার মানে এটা তোর ভাগের খাবার!তুই না খেয়ে আমার জন্য নিয়ে এসেছিস?
------হ্যাঁ ,মানে, তোমার জন্য কোন খাবার এখনো অ্যালটমেন্ট হয়নি। হয়তো তোমাকে 'হাওয়া মহলে' পাঠালে তোমার জন্য খাবার বরাদ্দ করা হতো।
---- একটা চেয়ার নিয়ে আমার পাশে বসতো।----------কেন?
-------- বসতে বলছি বস না ।
-----আরে, কেন বলতো?0
---- দেখতে পাবি ।
একটা চেয়ার টেনে নন্দিনী পলাশের পাশে বসে। ।পলাশ প্লেট থেকে রুটি আর সবজি নিয়ে নন্দিনীর মুখের সামনে ধরে বলে, হা কর, হা কর শিগগির।
----- ওইটুকু খাবারে তোমারই তো পেট ভরবে না, আবার আমাকে দিচ্ছ কেন?
------ তুই বোধহয় ভুলে গেছিস যে, একদিন আমরা ঠিক করেছিলাম ,দুজনের সুখ-দুঃখ সবকিছু দুজনে ভাগ করে নেব ।যদিও মাঝখানে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে ,তবুও আমি কথাটা ভুলতে পারিনি রে নন্দিনী।
------ পলাশদা!
---- হ্যাঁ, বল।
-----আমি তো ভেবেছিলাম সব ভুলে গেছো তুমি। তোমার নন্দিনী কে ও ভুলে গেছো।
------ ছাড় ওসব কথা । খাবার সামনে নিয়ে বসে থাকতে আমার একদম ভালো লাগেনা। শিগগিরই হা কর ,নইলে গাট্টা খাবি ছোটবেলার মতো । খাওয়ার পরে অনেকগুলো প্রশ্ন আছে তোর কাছে।
-----খেতে খেতেই বলো।
---- তোদের এই আশ্রমে ঠিক কি কি কাজ হয়? এত পাহারাদার ,এত গোপনীয়তা এখানে কেন? 'হাওয়া মহল' কি ? কি হয় ওখানে? তুই আমাকে ওখানে যেতে দিতে চাস না কেন ? কাল রাতে তুই মিথ্যে বিয়ের গল্প বলে আমাকে এখানে কেন এনেছিস?
(চলবে)
ConversionConversion EmoticonEmoticon