ভুল স্টেশনে নেমে
সমীরণ সরকার
ধারাবাহিক উপন্যাস ১৮ শ পর্ব
নন্দিনী ফিসফিস করে বলে,ওই ওরা বুঝি এসে পড়ল। না, আর কোন মতেই পাকা রাস্তা ধরে যাওয়া ঠিক হবে না ।
---কেন?
----- আমরা পাকা রাস্তা দিয়ে গেলে খুব সহজেই ওরা আমাদের ধরে ফেলবে ।
-----তাহলে কি জঙ্গলের ভিতর দিয়েই যেতে হবে?
----- হ্যাঁ।
------ কিন্তু এই অন্ধকারে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কিভাবে যাব?
------ আমি আছি তো, এসো আমার সঙ্গে।
(চার)
একটা জমাট বাঁধা অন্ধকারের সামনে পলাশকে দাঁড় করিয়ে নন্দিনী বলল, পলাশদা, এবারে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকব আমরা। জঙ্গলের ভিতরে কিছুটা আমি তোমাকে হাত ধরে নিয়ে যাব , তারপর নিজেকেই চলতে হবে তোমাকে।
----- কিন্তু কিভাবে? এত অন্ধকারে পথ দেখব কি করে?
----- কিছুটা চলার পরে দেখবে চোখে অন্ধকার টা সয়ে যাবে। তখন আর অতটা অসুবিধা হবে না।
------ জঙ্গলের ভিতর বুনো জন্তু জানোয়ার যদি কিছু থাকে।
------- যদ্দূর জানি ,এই জঙ্গলে শিয়াল আর ভাম ছাড়া আর কোনো জন্তু নেই।
---- সাপখোপ তো থাকতেই পারে।
-----তা পারে। তবে সেটা কপাল। কথায় আছেনা বাঘের দেখা আর সাপের লেখা নেহাত কপালের ব্যাপার।
পলাশ কোন উত্তর দেয় না।ও মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকায় । উপরে সীমাহীন অম্বরে ছোট-বড় অসংখ্য নক্ষত্রমালার উজ্জল আলপনা। রাতের আকাশ পলাশের খুব প্রিয়। গভীর রাতে ঘুম ভাঙলে সে মাঝে মাঝে ছাদে উঠে যায় নক্ষত্র শোভিত আকাশের রূপ উপভোগ করতে। এটা তার অনেক দিনের অভ্যাস। নন্দিনী ও জানে সেটা। তাই নন্দিনী বলল, কি দেখছো, আকাশ?
----- হ্যাঁ ,যদি আর দেখতে না পাই কোনদিন।
-----মানে?
------ জঙ্গলে যদি কোন বুনো জন্তুর আক্রমণে বা সর্প দংশনে মৃত্যু হয় তাহলে আর তো দেখা হবে না রাতের আকাশ।
----- তোমাকে মরতে আমি দেবোনা পলাশদা। স্বামী সর্বানন্দের আশ্রমে তোমাকে নিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তো আমার দায়িত্ব শেষ হবে না।
-------মানে? কি বলতে চাইছিস তুই?
------ কি বললে, আরেকবার বল। অনেকদিন পরে তোমার মুখে 'তুই' সম্বোধন শুনলাম।
-----না, আসলে পুরনো অভ্যাস তো-- তাই হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। কিছু মনে করো না নন্দিনী।
------ করব, যদি আবার 'তুই' এর বদলে 'তুমি' করে কথা বল।
----- কাকিমা কেমন আছেন নন্দিনী?
------ ভালো নেই। ভালো থাকার কথাও নয়।
-------মানে ?
------ আমিই তো মায়ের মস্ত বোঝা। এখন আমাকে বাঁচাতেই তো মায়ের লড়াই। এখন ওসব কথা থাক। চলো ,এবারে জঙ্গলে ঢুকি। আর দেরি করলে ওরা চলে আসতে পারে।
------ আমার কাছে একটা ছোট্ট টর্চ আছে। জানিনা ব্যাটারির আয়ু কতক্ষণ। তবুও টা জ্বালিয়ে কিছুক্ষণ তো পথ চলা যাবে।
------ ইস কি বুদ্ধি গো তোমার! টর্চ জ্বালালে ওরা আমাদের দেখতে পাবেনা!
----- অনেকদিন পরে তোর মুখে কথাটা শুনলাম।
----- কোন কথাটা?
-------- ওই যে--'ইস কি বুদ্ধি গো তোমার'। আগে তো প্রায়ই বলতিস।
নন্দিনী নিশ্চুপ। পলাশের বলা কথাটা তার বুকের মধ্যে তোলপাড় করে। মুহূর্তে তাকে পিছিয়ে দেয় বেশ কয়েকটা বছর। নানা রঙে রাঙানো ছোটবেলার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায় তার। তার খুব ইচ্ছে করে, সত্যি কথাটা পলাশকে বলে দেয়। ওকে ডাউন ট্রেন টা ধরিয়ে পাঠিয়ে দেয় চন্ডিপুরে ইন্টারভিউ দিতে। কিন্তু---না না, তাহলে যে মা , বিশু মামা বিপদে পড়বে।
নন্দিনী কে চুপ করে থাকতে দেখে পলাশ বিস্মিত হয়। তাহলে ওকি পুরনো দিনের কথা ভাবছে? হয়তো। পুরনো দিনের কথা খুব করে মনে পড়ছে তারও।
হঠাৎ একটা রাত জাগা পাখি মাথার উপর দিয়ে ডাকতে ডাকতে চলে গেলো। নন্দিনী চমকে উঠে বললো, আর কথা নয়, এবার চলো।
(চলবে)
ConversionConversion EmoticonEmoticon