পোড়া কপাল
বিশ্বনাথ সামন্ত
বিয়ের বারো বছর পরেও শিখার কোন বাচ্চা হলোনা। অথচ এই শিখা পড়াশুনায় খুবই ভালো ছিল, ছোট বেলা থেকেই ক্লাসে প্রথম পাঁচ জনের মধ্যে থাকতো। বাংলায় অনার্স করেছিল, মাষ্টার ডিগ্রি করে শিক্ষিকা হতে চেয়েছিল। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের চাপে শেষে পড়াশোনা ছেড়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। পাত্র হিসেবে কাজল খুবই ভালো, মাঝারি গড়নের ফর্সা সুন্দর চেহারা। তার সাথে ব্যাঙ্কে চাকরি করে, এমন পাত্র নাকি মধ্যবিত্ত পরিবারে হাতছাড়া করা যায় না। বিয়েটা খুব ঘটা করেই সম্পন্ন হয়েছিল। পাত্র দেখে অবশ্য শিখারও অমত ছিল না।যদিও তার ছোট বেলা থেকে শখ শিক্ষিকা হওয়া,সেটা হলোনা। তা হোক , এমন তো কত মেয়েই কত রকমের স্বপ্ন দেখে, কিন্তু প্রায় মেয়েদের ই সেই সব স্বপ্ন ভুলে গিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়।
বছর দুয়েক খুব সুখেই ছিল শিখা, শশুর শাশুড়ি দেওর নিয়ে ভরা সংসার। বাপের বাড়িতে আসতেই দেয়না, বাড়িতে সংসার সামলে জনা বিশেক ছেলে মেয়ে দের টিউশনি পড়ানোও শুরু করেছে। তাই বাপের বাড়ি যাওয়ার সময় পায় না। সেবার পুজোর সময় বাপের বাড়িতে এসে শাশুড়ির কত গুনগান করে গিয়েছিল। শাশুড়ি খুব মিশুক দুইজন মিলে বাড়ির কাজ করে, শাশুড়ি মা সবজি কাটাকুটি করে সে রান্না করে। শিখাকে তিনি নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন, শিখাকে পেয়ে নাকি ওনার মেয়ে না হওয়ার দুঃখ কষ্ট দুর হয়েছে। যদিও শিক্ষিকা হওয়া হলো না, তবুও বাড়িতে ছেলে মেয়েদের পড়িয়ে শিখার মনের সাধ কিছুটা হলেও মিটেছে। এভাবেই সুখে শান্তিতে কাটছিল শিখার জীবন।
বাদ সাধলেন পাড়ার রমা কাকীমা,রমা চৌধুরী একজন স্বামী হীনা মধ্যবয়স্কা বিধবা মহিলা। শিখার শশুর বাড়ীর পাড়ার সম্পর্কে কাকীমা, ওনার স্বামী বছর চারেক আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছেন, দুই ছেলে, বউমা নাতি নাতনী নিয়ে থাকেন। দুপুরে ওনার শোওয়ার অভ্যাস নেই, দিনের বেলায় শুলেই ওনার নাকি গা হাত পা ব্যাথা করে, রাত্রিতে আবার ঘুম আসে না। তাই রোজ দুপুরে পাড়ায় পাড়ায় এর ওর বাড়িতে গিয়ে গল্পের আসর বসান। নানান জিনিষ নিয়ে নিজের সুচিন্তিত মতামত জানান, কোন বাড়ির মেয়েটা কোন পাড়ার ছেলের সাথে প্রেম করে, কোন বাড়ির বউমা শশুর শাশুড়ি কে ভাত দেয়না, এইরকম সকল খবর থাকে ওনার কাছে।
উনিই একদিন শিখার শাশুড়ির কানে কথাটা তোলেন। তা কাজলের মা আড়াই তিন বছর হতে চললো তোমার বউমা পোয়াতি হলো না তো। তা ডাক্তার পত্তর দেখাচ্ছো তো নাকি ?দিশা তখন ঘরের ভেতর শুয়ে রবিন্দ্রনাথের গল্প বই পড়ছিল। ঘরের ভেতর থেকে শিখা বুঝতে পারলো তার শাশুড়ি মা চুপ করে বসে আছেন, কোন উত্তর দিতে পারছেন না।তা দেখে রমা কাকীমা আবার বলতে শুরু করল আজকালকার যুগের ছেলে মেয়ে দের বুঝিনা বাপু,কি সব ছাই পাস বড়ি ট্যাবলেট খায়।ওই তো বেরা পাড়ায় নিতাই এর বউটা, ওমন ট্যাবলেট খেয়ে খেয়ে আর বাচ্চাই হচ্ছে না,কত ডাক্তার বদ্যি, ঠাকুরের মানত কিছুই কাজ হচ্ছে না। ছেলে বউমা দের বুঝিও ওরা তো ছোট, ওদের কি আর অত ঞ্জান হয়েছে। এই বলেই রমা কাকীমা বলেন আজ তবে আসি কাজলের মা।
সেই দিনই রাতে কাজল খেতে বসেছে, খাওয়ার টেবিলে প্রথমেই কাজলের মা ওই কথাটা তুললেন। খোকা অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম তোকে একটা কথা বলি, অনেক দিন তো হলো, এবার আমায় একটু নাতি নাতনির মুখ দেখা দেখিনি,ঘরটাও কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে,একটা বাচ্চা আসলে ঘরটাও কেমন গমগম করবে।
কাজল খেতে খেতে খাওয়া থেকে অন্যমনস্ক হয়ে যায় ,কাজল আর শিখাও চেষ্টা তো আর কম করেনি,এর আগে ই বাড়িতে না জানিয়ে গাইনি বিভাগের ডাক্তার বৈদ্য র চেম্বারে দুই বার দেখিয়ে এসেছে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি, একটু চুপ করে থাকার পর ,কাজল বলে হুমম, মা দেখছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
সেবার কাজল আর শিখার পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে বাড়িতে ছোট করে একটা অনুষ্ঠান। বেশী কেউ নেই, শিখার মা এসেছেন, আর কাজলের জনাকয়েক বন্ধুরা। কাজলের মা তাদের সামনেও বলতে ছাড়েননি, শিখা যখন শাশুড়ি মা কে প্রণাম করে আশির্বাদ নিতে গিয়েছিলো, তখনই শাশুড়ি মা বলে চলেন বছর তো বেড়েই চলেছে, আমার বোধহয় আর নাতি নাতনীর মুখ দেখার সৌভাগ্য হবে না। ঘরভর্তি লোকের কাছে কি লজ্জায় পড়ে গেছিল শিখা, কোন রকমে রান্না ঘরে গিয়ে লুকিয়ে চোখের জল মুছে ছিলো।পেছন পেছন কাজল ও গিয়ে পৌঁছে ছিল, সান্ত্বনা দিয়ে ম্যানেজ করেছিল কোনোরকমে।
এরপর দিন যত যায়, চেনা মুখ গুলো অচেনার মতো আচরণ করতে থাকে।যে শাশুড়ি মা সব জায়গায় শিখার গুনোগান করতেন, সেই তিনি এখন উঠতে বসতে অপমান সূচক কথাবার্তা বলা আরম্ভ করেছেন। বাড়িতে যখনই কোন আত্মীয় স্বজন আসেন, খাবারের টেবিলে এই একটা জিনিসের উপরই আলোচনা চলতে থাকে।এর ওর কথা মতো এই মন্দির এর উপোস, ওই মন্দিরে দন্ডি খাটা, শনি ঠাকুরের বার ব্রত সবই চলে। এমনকি চার ছয়টি (infertility) ক্লিনিক ও ঘোরা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু রেজাল্ট সেই একই, আসলে দোষটা কাজলের। কাজলের শুক্রাণু সংখ্যা খুবই কম, যে পরিমান আছে শুক্রাণু সেটা সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু এটা একমাত্র কাজল আর শিখাই জানে, বাড়িতে বা সমাজে একথা প্রকাশ করা যায় না।
সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ই ধরে নেওয়া হয়, সন্তান না হওয়াটা আসলেই মেয়েদের ত্রুটি ।
তাই এই ঠাকুরের কবচ,ওই ঠাকুরের ফুল,ওন্য কোনো মন্দিরের চরণামৃত পান,বা কোন ঠাকুরের বার ব্রত মেয়েদের দিয়ে করানো হয়।
তার সাথে চলে পারিবারিক, সামাজিক শোষণ, উৎপীড়ন। রাস্তায় বের হলে ছেলের নানারকম কটুক্তি করে, পুকুর ঘাটে জলের কলে মেয়ে বউরাও দেখে হাসাহাসি করে। অন্যান্য বাচ্চাদের তার কাছে আসতে দিতে চায় না, কোন বাচ্চা কে লজেন্স দিলে সেটা তার মা ফেলে দেয় তাকে খেতে মানা করে। টিউশনি পড়ানোও ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়, কোন ছেলে মেয়েদের বাবা মা ই তাদের বাচ্চাদের পড়তে পাঠায় না।
বছর যত বাড়ে তার সাথে পালা করে বেড়ে চলে অনুশাসন, সামাজিক বয়কট, কোন পোয়াতি বউ এর ধারে কাছেও যেতে দেওয়া হয় না। কোন শুভ কাজে যেতে দেওয়া হয় না, এমনকি কেউ শুভ কাজে বের হলে তার মুখ দেখতে চায় না। তার মুখ দেখে গেলে নাকি সেই কাজ হয় না।
হায়রে অন্ধ সমাজ তবুও কেউই তার স্বামীর উপর সন্দেহ প্রকাশ করে না।আর শিখার মতো মেয়েরা স্বামীর কথা ভেবে মুখ বুজে সহ্য করে।
ConversionConversion EmoticonEmoticon