সাংসারিক ভালোবাসা
গোপেশ দে
লোকটা রোজ সকাল আটটায় ঘুম থেকে ওঠে।তারপর দাঁতব্রাশ, স্নান খাওয়া সেরে বাসে ঝুলে অফিসে যায়।অফিস থেকে ক্লান্ত পায়ে সন্ধে সাতটায় ঘরে ঢুকে।
বউ স্বামীর জন্য অপেক্ষায় থাকে।এরকম একটা বাঁধা ধরা রুটিনের মধ্যেই চলছে লোকটার জীবন।
বউ একমাত্র ছুটির দিনেই স্বামীকে ভালোমত কাছে পায়।সেদিন বড্ড খুনসুটি, গল্প, ভালোবাসায় ঘর মাখামাখি হয়ে যায়।ফুরুৎ করে উড়ে যায় ছুটির দিনটা।বউ ভাবে, ইস ! এত তাড়াতাড়ি সময় যায় কেন ?
সুদেষ্ণার মনে শান্তি আসে না।সে চায় স্বামী তার কাছে এরকম প্রতিটা দিন থাকুক।কিন্তু সে উপায় কোথায় ? চাকরীর জন্য রাহুলকে তো অফিসে বেরুতেই হবে।
সুদেষ্ণা প্রায়ই ঘুমানোর সময় রাহুলকে বলে, 'চলো কোথাও ঘুরে-টুরে আসি।'
রাহুল 'যাব' বলে বউকে আশ্বস্ত করে রাখে।তারা যে বিয়ের পর কোথায় ঘুরতে যায়নি তা নয়।দুবার ট্যুরে গেছে তিনবছরের দাম্পত্য জীবনে।একবার দার্জিলিং আরেকবার দীঘা।
আজ সকালে সুদেষ্ণার কলেজ লাইফের বান্ধবী মৌসুমী কল করেছিল।
'হ্যারে কেমন আছিস বল ?'
'আমিতো এই আছি।সংসার করছি।তা তুই কেমন আছিস ?'
'এই চলছে।তোর মত তো আর সংসারী হতে পারলাম না।তাই মাঝেমধ্যে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ঘুরে বেড়াই।'
'কেন ? সংসারী হতে পারছিস না কেন ? বিয়ে করে ফেল।'
'করব রে করব।আরেকটু ইনজয় করে নিই।'
'বিয়ে করে ইনজয় করা যায় না বুঝি !'
'যায় যায়।যার জন্য ফোন করা তোকে, আজ আমার বাসায় চলে আয়।একটা পার্টি দেব।কলেজের ফ্রেন্ডসরা আসবে।'
'কারা আসবে ?'
'উফ! আরে এলেই বুঝবি।আগ বাড়িয়ে এত কিছু বলব না।'
'আচ্ছা।তা কখন ?'
'এখনই আয় না।'
'এখন ! না রে।ঘর খালি রেখে আসব না।ও আসুক।গেলে একসাথেই যাব।'
'বেশ।তা তোর বর অফিস থেকে ফিরবে কখন?'
'সাতটায়।'
'বেশ।তখনই আসিস।আসবি কিন্তু'
'হুম।'
সুদেষ্ণার খুব যেতে ইচ্ছে করছে পার্টিতে।অনেকদিন পর কলেজের ফ্রেন্ডস দের সাথে দেখা হবে।কিন্তু রাহুল যেতে রাজী হবে তো? বেচারা অফিস থেকে এসেই শুয়ে পড়ে।বড্ড টায়ার্ড থাকে কিনা।রাহুল না যেতে চাইলে সে কি একা যাবে ? আলনায় কাপড় গোছাতে গিয়ে ভাবল সুদেষ্ণা।
রাহুল বাসায় এল সন্ধে সাতটার একটু পর-পরই।সুদেষ্ণা চা বানাতে গেল।একসাথে চা খেতে খেতে পার্টির প্রসঙ্গ তোলা যাবে।
রাহুল অফিস থেকে এসে একেবারে ঘামে নেয়ে উঠেছে।যা গরম পড়েছে ! সে ড্রেস চেঞ্জ করে বাথরুমে গেল।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে রুমে ঢুকেই দেখল সুদেষ্ণা দু'কাপ চা টেবিলের ওপর রেখে তার জন্য বসে আছে।মুখটা বেজায় হাসিহাসি সুদেষ্ণার।
'এই বলছি আমার একটা কথা রাখবে ?'
'রাখার মত হলে অবশ্যই রাখব বেবি।'
বেবী ডাকায় সুদেষ্ণার একটু স্বস্তি হল।রাহুলের মন বেজায় ভালো থাকলেই এই নামে ডাকে।
সুদেষ্ণা বলল, 'বলছি চল না একটু ঘুরে আসি।'
'কোথায় ?'
'মৌসুমী ফোন করেছিল তুমি যাওয়ার পরপরই।বলছে আজ পার্টি দেবে।'
'কিসের পার্টি ? জন্মদিনের নাকি ?'
'না।ওসব তো কিছুই বলল না।বোধহয় এমনি দেবে।'
'ও।তা এখনি যেতে চাও ?'
'হ্যাঁ।চল না ঘুরে আসি।সারাদিন তো বাসাতেই থাকি।'
রাহুলের যেতে ইচ্ছে করছে না।তবুও অনিচ্ছায় বলল, 'বেশ রেডী হও।'
রাত আটটায় ওরা মৌসুমীর বাসায় পৌঁছে গেল।মৌসুমী ওদের দেখে বেজায় হাসিখুশি মুখ করে বলল, 'বাব্বা এসেছিস ? আমিতো ভেবেছি তুই আসবিই না।'
সুদেষ্ণাও একগাল হেসে দিল, 'হ্যাঁরে তুই বলেছিস আর আমি আসব না ? তা কাকু, কাকীমা কোথায় ?'
'বাবা-মা বেড়াতে গেছে।আসবে অনেক রাত করে।এইজন্যইতো পার্টি।'
ততক্ষণে বান্ধবীরা সবাই সুদেষ্ণার কাছে চলে এল।কুশল জানল।সেলফি তুলল।
সুদেষ্ণা দেখল, দুটো ছেলে সোফায় বসে গল্প করছে।ছেলেদুটোও ওদের ক্লাসমেট ছিল।
একজনকে দেখে সুদেষ্ণা চমকে উঠল।ছেলেটিও ওকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল সোফা থেকে।একনজরে তাকিয়েও রইল।সুদেষ্ণার অস্বস্তির সীমা রইল না।তার কলেজ লাইফের স্মৃতি নাড়া দিয়ে উঠল।দিবাকরের সাথে কলেজে দুবছরের প্রেম ছিল।কথা ছিল দুজন দুজনকে বিয়ে করবে।কিন্তু দিবাকরের চাকরি না হওয়ায় সুদেষ্ণাকে ফ্যামিলির চাপাচাপিতে রাহুলের সাথে বিয়ে বসতে হয়।
প্রথম প্রথম সুদেষ্ণা মন মরা করে থাকত কিন্তু পরে সব ঠিক হয়ে যায়।বিয়ের পর দেখে রাহুল ছেলে হিসেবে যথেষ্ট ভালো।রাহুল যে তাকে বউ হিসেবে পেয়ে বেজায় খুশি এটা বুঝতে পেরেই সেও সংসারটাকে আরো আঁকড়ে ধরে থাকে।
এতদিন বাদে দিবাকরের সাথে এভাবে দেখা হবে ভাবতেই পারেনি সে।সুদেষ্ণা রাহুলের দিকে তাকাল।রাহুল গোবেচারা মুখ করে পত্রিকা হাতে নিয়ে বসে আছে সোফার এক কোণে।পার্টিতে তার মন নেই।আসলে বউকে খুশি করার জন্যই আসা।সুদেষ্ণাও সেটা জানে তাইতো রাহুলকে ছাড়া কিছু বোঝে না এখন।
দিবাকর হঠাৎ সুদেষ্ণার কাছে এগিয়ে গেল, 'তোমার বর দেখতে বেশ সুপুরুষ।'
'থ্যাংকস।সুদেষ্ণা বড্ড ভয় পাচ্ছে।রাহুল যদি কিছু বুঝতে পারে।'
'তোমার বাসার ঠিকানাটা দেবে একটু ?'
সুদেষ্ণা দেখল সেই পুরোনো ভালোবাসার স্মৃতি জাগতে শুরু তার মনে।সে রাহুলকে ঠকাতে চায় না।এই সংসারটাকে নষ্ট করার কোনো মানেই নেই।সে অন্য একজনের বউ।রাহুলকে সে এখন বড্ড ভালোবাসে।সুদেষ্ণার বড় অস্বস্তি হতে লাগল।দিবাকর ঠিকানা চাইছে কেন ?
হঠাৎ মাথাধরার অজুহাত দেখিয়ে মৌসুমীকে ডাকল, 'মাথায় পেইন হচ্ছে খুব।আমরা আসি তাহলে আজকে।'
'এখনি যাবি ? আরেকটু থাক না।'
'নারে।আমার একটু মাইগ্রেন আছে।'
'তাহলে চলেই যাবি এখন ?'
হ্যাঁরে ফোনে কথা হবে।
দিবাকর সেখানে দাঁড়িয়েই ছিল।সে সুদেষ্ণার হাতটা আচমকা ধরে বসল, 'এই থাকো না আরেকটু ?'
সুদেষ্ণা বড্ড ভয় পেয়ে গেল।অথচ বিয়ের আগে তার এই হাত যে কতবার ধরেছে দিবাকর তার কোনো হিসেব নেই।
সে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে রাহুলের দিকে তাকাল।রাহুল দেখেনিতো আবার ? দেখলে কী ভাবতে পারে ?
ছেলেটা এমনিতে কিছু বলবে না।খুব ঠান্ডা মাথার ছেলে তবুও খুব কষ্ট পাবে হয়ত।রাহুলকে সে দুঃখ দিতে চায় না।কিন্তু দিবাকর যদি খুব বেশী পাগলামি করে এখন তার সাথে তাহলে রাহুল কিভাবে নেবে বিষয়টা।ভালোবাসা কমে যাবে নাতো ওর ?
রাহুল অন্য দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
সে রাহুলের কাছে এসে দাঁড়াল, 'বলছি, আমার না মাথা ব্যথা করছে।চলো বাসায় যাব।'
'এইত এলে।এখনি...'
'হ্যাঁ।চলো।ভীষণ মাথা ধরেছে।'
'ওরা কী ভাববে ?'
'আরে ওদের বলেছি।ওরা কিছুই ভাববে না।'
সুদেষ্ণা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, 'চলি রে।শরীরটা ভালো ঠেকছে না।আরেকদিন আসব।ভাল থাকিস সবাই।'
রাতে বিছানায় শুয়ে সুদেষ্ণা বড্ড বেশি চিন্তিত হয়ে গেল।দিবাকর যদি তাদের বাসায় আসে ? রাহুল যদি সবকিছু জানতে পারে ? এত সুন্দর সাজানো সংসার তাহলে কি ভেঙে যাবে ?
কিছুক্ষণ পর তার মোবাইলে রিং বাজল।সুদেষ্ণা মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল একটা অচেনা নম্বর।তার মন বলছে কলটা দিবাকরের।ভয়ে ভয়ে ফোনটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরল।
'আমি দিবাকর সুদেষ্ণা।'
সুদেষ্ণার হাত কেঁপে উঠল।সে রাহুলের দিকে তাকাল।রাহুল অঘোর ঘুমে।শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার ঘুম পায়।
'হ্যাঁ' সুদেষ্ণা কথাটা বলে ব্যালকনিতে দাঁড়াল।
'কেমন আছ ?'
'ভালো।নম্বর কোথা থেকে পেলে ?'
'মৌসুমী দিল।বলছি আমরা কি আগের মত হতে পারি না সুদেষ্ণা ?'
সুদেষ্ণা ফোনটা কেটে দিল।রুমে ফিরে আসতেই আবার রিং বাজল।
সে কলটা কেটে সুইসড অফ করল মোবাইলটা।কলকাতা শহরটা বড্ড অসহ্য লাগছে তার কাছে।ভয় আর দুশ্চিন্তা নিয়ে এপাশ ওপাশ করল।এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল সে।
দরজায় কলিং বেজ বাজছে।সুদেষ্ণা গিয়ে দরজাটা খুলতেই দেখল দিবাকর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।সে ভয়ে কুঁকড়ে গেল।ঘরে রাহুল নেই।এখন কি হবে ? কি চায় এখন দিবাকর।দিবাকর রুমে ঢুকে বলল, 'এক কাপ চা খাওয়াও তো সুদেষ্ণা।'
সুদেষ্ণার মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না।সে ভয়ে সিটিয়ে আছে।
দিবাকর সোফায় বসে পড়ল তারপর বলল, 'আমাকে বিয়ে করো সুদেষ্ণা।'
সুদেষ্ণা বলতে চাইছে, 'এখান থেকে যাও প্লিজ।রাহুল জানলে ও খুব কষ্ট পাবে।আমি এখন অন্য একজনের বউ।আমার সংসার নষ্ট করো না প্লিজ।'
কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না কেন ?
'বাইরে একটা গাড়ি দাড় করানো।চলো আমরা লং ড্রাইভে যাই।'
দিবাকর সোফা থেকে উঠে সুদেষ্ণার কাছে এলো হঠাৎ হাতটা ধরে ফেলল তার।তারপর জড়িয়ে ধরতে গেল।
সুদেষ্ণা এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটু তফাতে দাঁড়াল।কোনো কথা বেরুচ্ছে না কেন তার ?
'আগে তো আদর করতে দিয়েছো।কত চুমু খেয়েছি তোমায় মনে আছে সুদেষ্ণা ?'
দিবাকর সদর দরজার কাছে গেল।সুদেষ্ণা দেখল দিবাকর চলে যাচ্ছে এবার।যাওয়ার সময় সিড়ির কাছে দাঁড়িয়ে বলল, 'তুমি কলকাতার যেখানেই থাকো।তোমার কাছে আমি আসবো।'
সুদেষ্ণার ঘুম ভেঙে গেল।এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল সে।সে রাহুলের দিকে তাকালো।রাহুল ঘুমোচ্ছে।
সুদেষ্ণা ঘড়ি দেখল।রাত তিনটে বাজতে দশ।সে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগল।কিন্তু ঘুম আর এলো না।
সকালে রাহুল ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সুদেষ্ণা বলল, 'এই একটা কথা ছিল ?'
'বলো বেবি।'
'আমার না কলকাতা শহরটা একদমই ভালো লাগছে না।'
রাহুল হেসে ফেলল, 'হঠাৎ এই কথা।অবশ্য আমারও খুব একটা ভালো লাগে না।'
'তাই বলছি কি চল না তোমার গ্রামের বাড়িতে চলে যাই।ওখানে তোমার মা বাবা আছেন।একসাথে থাকব।'
'কিন্তু আমার চাকরি ?'
'চাকরি ছেড়ে দাও।এই খাটুনিতে তোমার শরীরের যা হাল হয়েছে না !'
'হঠাৎ এরকম প্রশ্ন কেন ?'
'আমার কলকাতা ভালো লাগছে না।গ্রামে থাকতে ইচ্ছে করছে।'
'চাকরি ছাড়লে খাব কী ?'
ওখানে তো তোমাদের বড় ব্যবসা আছে।আমার 'শ্বশুর মশাই আই মিন তোমার বাবার তো চালের আড়ৎ আছে।সেটার তুমি দেখাশোনা করবে।'
'তা মন্দ বলনি।বাবাও আমাকে এই কথা অনেক আগে বলেছিল।'
'তাছাড়া চাকরি তো সরকারি না।প্রাইভেট ফার্মে যে খাটুনিটা হচ্ছে তারচেয়ে গ্রামে গেলে এত খাটতে হবে না তোমার।'
'বটে?'
'হ্যাঁ গো হ্যাঁ।তোমাকেও একপ্রকারে সারাদিন কাছে পাব।'
'কিন্তু তুমি তো শহরের মেয়ে কলকাতাতেই বিএ পাশ করলে।এখন কলকাতা ছেড়ে গ্রামে যেতে চাইছ।থাকতে পারবে তো ?'
'খুব পারব।'
'ঠিক আছে ভেবে দেখি।'
'এত ভাবাভাবির কিছু নেই।তুমি আজকেই রেজিগনেশন লেটার বসকে ধরিয়ে দেবে।'
রাহুল সুদেষ্ণার খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বলল, 'যা বলছ ভেবে বলছ তো ?'
'হ্যাঁ।ভেবেই বলছি।'
'বেশ।তাই হবে।'
সুদেষ্ণা রাহুলের গালে একটা চুমু খেল, 'আমার জন্য একটা নতুন সিম আনবে তো।'
'কেন? সিমের আবার কি হল ?'
'না।নতুন জায়গা যাচ্ছি।নতুন সিম।'
রাহুল হেসে ফেলল, 'ওকে।'
রাহুল বেরিয়ে যেতেই সুদেষ্ণা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।রাহুল যে তার সব কথা শুনবে সেটা সে জানে।এত ভালো আর সহজ সরল ছেলে হয় না।ওকে সে কোনোভাবেই কষ্ট দিতে চায় না।
সংসারটা নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না।সে চায় রাহুলকে নিয়ে সুখের একটা সংসার।রাহুলকে ছাড়া সে কিছুই এখন ভাবতে পারে না।স্বামীকে বড্ড ভালবাসে কিনা।দুদিন ধরে বমি বমিও লাগছে তার।সুখের অনুভূতি যেন ।
আরও পড়ুন
ConversionConversion EmoticonEmoticon