ধারাবাহিক উপন্যাস
ভুল স্টেশনে নেমে
ষষ্ঠ কিস্তি
সমীরণ সরকার
বৃষ্টিটা থেমে গেছে বলে মনে করে শেডের বাইরে আসতেই পলাশ বুঝতে পারলো যে, ওটা সম্পূর্ণ থামেনি। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের ভোরে গাছপালার পাতা বেয়ে যেমন টুপটাপ ঝরে পড়ে নীহার কণা, ঠিক তেমনি নিঃশব্দে ঝরছে ইলশেগুঁড়ি।
কি করবে পলাশ? আবার কি শেডের নিচে ফিরে যাবে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে নাকি এগিয়ে যাবে সামনে?
মুহূর্তের দোলাচল।তারপর দূরে দেখা আলোর উৎস সন্ধানে যাওয়াটাই শ্রেয় মনে করলো পলাশ। হোকনা মৃদু আভাস ,তবুতো আলো, অন্ধকার থেকে মুক্তির হাতছানি। পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে মাথায় বেঁধে নেয় পলাশ।
আলোর কাছাকাছি পৌঁছে দেখে একটা ছোট্ট ঘরের ভেতর থেকে আলো আসছে। ঘরের সামনে একটা ছোট্ট বারান্দা। এখানেও বারান্দাতে একটা লোহার বেঞ্চি পাতা আছে।
ঘরটার দুটো জানলা। দুটোই বন্ধ। জানলার পাল্লা গুলোর নিচের অংশ কাঠ দিয়ে তৈরি হলেও উপরে কিছুটা অংশে কাঁচ লাগানো আছে। একটা পাল্লার কাঁচ ভাঙা। ভাঙা অংশে কাগজ সাঁটানো আছে। ঝড়ের প্রাবল্যে কিংবা অন্যকোন ভাবে সেই কাগজের কিছুটা অংশ ছিঁড়ে গেছে। আর সেই ছেঁড়া অংশের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছে আলো।
পলাশ দরজা ঠেলে দেখে সেটা ভেতর থেকে বন্ধ আছে। বার দুয়েক দরজার গায়ে আঘাত করতেই ভেতর থেকে আওয়াজ আসে, কৌন?
---- দরজাটা একটু খুলুন।
---- আপ কৌন হ্যায়?
----- আমি একজন যাত্রী। চন্ডীপুর যাওয়ার টিকিট নেবো।
---- টেরেন তো বহুত লেট হ্যায়।
--- ঠিক আছে। দরজাটা খুলুন না একবার।
---- আ রহা হ্যায়।
কিছুক্ষণ পরে দরজাটা খুলতেই পলাশ দেখে, তার সামনে আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন দীর্ঘদেহী স্বাস্থ্যবান পুরুষ। লোকটার মুখ চাদর দিয়ে এমনভাবে ঢাকা আছে যে ,ওর চোখ, নাক আর পুরু মোটা কাঁচাপাকা গোঁফটাই নজরে আসে। লোকটার হাতে একটা লন্ঠন। ঘরের ভিতরটা অন্ধকার। লণ্ঠনের হালকা আলোয় যতটুকু দেখা যায় তাতে পলাশ দেখলো যে,ঘরটা খুব ছোট। ঘরের ভিতরে একটা কাঠের টেবিল, গুটিদুয়েক চেয়ার,একটা কাঠের টুল আর একটা স্টিলের আলমারি আছে। টেবিলের উপর ফোন আছে একটা
পলাশ হাতজোড় করে বলে, নমস্কার মাস্টারমশাই। আমাকে একটা চন্ডিপুর যাওয়ার টিকিট দিন। ট্রেনের খবর কি? রাইট টাইম নাকি.....?
লোকটা জিভ কেটে বলে, নেহি নেহি বাবুসাব,হামি মাস্টার সাব না আছি।হামি ভিখু রাম বাবু, মাস্টারবাবু কা নোকর।
---- ভিখুরাম,স্টেশন মাস্টার বাবু কোথায় ?
----- মাস্টারবাবুকা তবিয়ত আচ্ছা নেহি। উনি থোড়া রেস্ট লেনে কে লিয়ে কোয়ার্টারে গেছেন।
----- কিন্তু আমার যে একটা চন্ডিপুর যাওয়ার টিকিট দরকার।
------ টিকেট তো মাস্টারবাবু দেবেন। লেকিন বাবু, চন্ডিপুর যানে কা টেরেন তো বহুত লেট আছে।
----- লেট! কত লেট?
------ মাস্টার বাবু তো বলছিলেন,তিন ঘন্টা লেট।
------ অ্যাঁ! তিন ঘন্টা লেট?
---- হাঁ, মাস্টারবাবু তো তাই বলছিলেন।
পলাশ খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। তিন ঘন্টা লেটে ট্রেন এলে সে কি সময়মতো চন্ডিপুরে পৌঁছাতে পারবে? তার থেকেও বড় সমস্যা তিন ঘণ্টা সময় ঐ চারদিক খোলা শেডে অপেক্ষা করা। পলাশ বলল, এখানে কোন ওয়েটিং রুম নেই?
--- ওয়েটিং রুম!
----- হ্যাঁ, ঝোড়ো বাতাসের মধ্যে ওই খোলা শেডে তিন ঘন্টা বসে থাকা তো খুব কষ্টকর।
ভিখুরাম কিছুক্ষণ কি যেন চিন্তা করল, তারপর বলল, আপ মেরে সাথ আইয়ে বাবুজি।
--- কোথায়?
------- আইয়ে না।
লন্ঠন হাতে আগে আগে এগিয়ে চলে ভিখুরাম, পিছনে পলাশ। কিছুক্ষণ চলার পর স্টেশন মাস্টারের রুমের ঠিক পিছনে একটা বড় শেডের নিচে এসে দাঁড়ালো ভিখুরাম। এই শেডটার মাথায় টিনের চাল থাকলেও তিন দিকে পাকা দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। লোহার বেঞ্চির বদলে এখানে দেওয়াল ঘেঁসে ঢালাই পাকা বেঞ্চি। তিনদিক ঘেরা বলে এখানে বাতাস ঢুকছে কম।
ভিখুরাম বলল, হাপনি এখানে বসুন বাবু। মাস্টারবাবু এলে হামি আপনাকে খবর দিবে। হাপনি তখন টিকিট লিয়ে লিবেন।
---- ঠিক আছে ভিখুরাম, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। মাস্টারমশাই এলেই আমাকে খবর দেবেন কিন্তু।
----হাঁ,বাবুজী।
ভিখুরাম লন্ঠন নিয়ে চলে গেল। টর্চের ক্ষীন আলোয় বেঞ্চিটা একটু দেখে নিয়ে বসে পড়লো পলাশ। হঠাৎ তীব্র আলোক রশ্মি আকাশের বুক চিরে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল।
(চলবে)
আরও পড়ুন -
ConversionConversion EmoticonEmoticon