ধারাবাহিক উপন্যাস তৃতীয় কিস্তি ভুল স্টেশনে নেমে
সমীরণ সরকার
(দুই)
ট্রেন থেকে নামতেই নিকষ কালো অন্ধকার যেন আপাদমস্তক গ্রাস করল পলাশকে। ট্রেনের ভেতর থেকে সামান্য যে আলোর ছটা বাইরে এসে পড়ছিলো, তাতে ঠিকমত পথ দেখা যাচ্ছিল না। এদিক ওদিক তাকিয়ে সারা স্টেশনে কোথাও একটা আলোর বিন্দু ও চোখে পড়লো না পলাশের। কোন দিকে যাবে ও? ডাইনে না বাঁয়ে। এসব ভাবতে ভাবতেই ট্রেনটা ছেড়ে দিল। একসময় ট্রেনের পিছনের টকটকে লাল টেল লাইটটাও চলে গেল চোখের আড়ালে। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রে দিক হারানো নাবিক যেমন কোন উপায় না দেখে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সমর্পণ করে দিয়ে পরম শক্তিমানের করুণা প্রার্থনা করে, পলাশ ও তাই করল। শিব ,দুর্গা, কালী, মা তারা, মা শীতলা সবাইকে মনে মনে বারকয়েক ডেকে নিল পলাশ, এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য। আর ঠিক তখনই ঝলসে উঠল সৌদামিনী ।মুহুর্তের জন্য সমস্ত জায়গাটা আলোকিত হয়েে উঠলো। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই পলাশের মনে পড়ে গেল যে, বাড়ি থেকে ঠিক বেরোবার মুখেই ছোট বোন সুমিতা একটা ছোট টর্চ পলাশের আপত্তি অগ্রাহ্য করে প্রায় জোর করে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ওর কাঁধের ব্যাগে। মোবাইলে না হয় চার্জ্জ নেই, টর্চটা তো আছে। তাড়াতাড়ি ব্যাগের চেন খুলে ভিতরটা হাতড়াতে শুরু করেে পলাশ। পেয়ে যায় টর্চটা। কিন্তু একি, সুইচ টিপেও তো জ্বলছে না ওটা! বার তিনেক টর্চটা ঝাঁকিয়ে এবং দুবার হাতের তালুতে ঠোকার পরে ওটা জ্বলে উঠলো। যদিও আলোক শিখা খুব ক্ষীণ। মনে হয় টর্চের ব্যাটারিও বোধহয় শেষ হয়ে এসেছে। টর্চের আলোটাকে এদিক ওদিক করতে করতেই বেশ কিছুটা দূরে একটা টিনের শেড নজরে আসে পলাশের। আকাশের দিকে তাকায় পলাশ। যেকোন মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে। এলোমেলোো হাওয়া বইছে। বৃষ্টিটা আসার আগেই শেডের নিচে আশ্রয় নেওয়াটা শ্রেয়়় মনে করে দ্রুত শেডের দিকে পা চালায় পলাশ। শেডের নিচে পৌঁছানোর আগেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়।
টর্চের মৃদু আলোয় একটা লোহার বেঞ্চি দেখতে পায় পলাশ। কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে বেঞ্চিতে বসার আগেই আবার চতুর্দিক আলোকিত করে ঝলসে ওঠে অশনি। জোরে বৃষ্টি নামে। দুশ্চিন্তায় পড়ে পলাশ। ফেরার ট্রেনটা যদি কোন কারণে বেশি লেট করে তাহলে তো ঠিক সময়ে চন্দ্রপুরে পৌঁছাতে পারবে না। বিমল মামার বাড়িটা খুঁজে বের করতেও তো সময় লাগবে। আর সমস্যা মিটিয়ে ঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছতে হবে। তা না হলে তো আবার হাতছাড়া হয়ে যাবে সুযোগটা। তবে ইন্টারভিউ দিতে যে সিলেক্টেড হবেই তারতো কোন গ্যারান্টি নেই। যদিও বিমল মামা জানিয়েছেন যে, স্কুলের হেডমাস্টার মশাই এবং স্কুল কমিটির সেক্রেটারির সঙ্গে কথাবার্তা বলে ইতিবাচক আশ্বাস পেয়েছেন। আর এখন যদি ঠিক সময়ে ইন্টারভিউয়ের জন্য স্কুলে পৌঁছাতে না পারে পলাশ তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে।
কেন যে ওভাবে ঘুমিয়ে পড়ল সে ,সেটা ভাবতেই নিজের উপরে খুব রাগ হয় পলাশের। আর ঘুমালো বলে এতক্ষণ ধরে ঘুম?
না, আর ভাবতে পারছেনা পলাশ। এ চাকরিটা পাওয়া তার ভীষণ দরকার। চাকরিটা যদিও একটা হাই স্কুলের নাইট গার্ডের চাকরি। তবুতো স্থায়ী চাকরি। এই চাকরিটা পেলেই বর্তে যায় পলাশ।
কলেজ থেকে পাস করে বেরিয়েছে আট বছর আগে। ইচ্ছে ছিল মাস্টার ডিগ্রি করার। অনার্সে ফার্স্ট ক্লাসও ছিল ওর। কিন্তু বিধি বাম। কলেজের রেজাল্ট বেরোবার পরদিনই রাত্রে সেরিব্রাল অ্যাটাক হ'ল ওর বাবার।প্রায় দেড় মাস যমে মানুষে টানাটানি। হাসপাতাল, ডাক্তার, ওষুধ, ,ইনজেকশন আরো কত কি। অবশেষে মানুষটা বেঁচে বাড়ি ফিরলেন বটে কিন্তু বাঁ হাত বাঁ পা পঙ্গু হয়ে গেল। সেই থেকেই বাবা শয্যাশায়ী। একটা বেসরকারি ফার্মে চাকরি করতেন পলাশের বাবা। কম্পালসারি রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট হিসেবে যে টাকা উনি পেলেন, তার একটা বড় অংশ খরচ হল চিকিৎসার জন্য করা ধারদেনা মেটাতে। বাকি টাকাটা পোস্ট অফিসে এমআই এস স্কিমে ফেলে সুদের পয়সায় কোনরকমে বাড়ি ভাড়া আর দুবেলা ডাল ভাত জোটে। ছোট বোনটা স্কুলের পড়া শেষ করে কলেজে ঢুকেছে। ওর লেখা পড়ার খরচ, বাবার ওষুধপত্রের খরচ আর সংসারের অন্যান্য খরচের দায় মেটাতে চুটিয়ে ট্যুইশনি করা ছাড়া আর কোন পথ খুঁজে পায়নি পলাশ। এরই ফাঁকে চাকরির জন্য দরখাস্ত করা, গাইডবুক ফলো করা, চাকরির জন্য পরীক্ষা দেওয়া এসব তো আছেই। কিন্তু এতসব করেও আজও পলাশের ভাগ্যে চাকরির শিকে ছেঁড়েনি।
তাই বিমল মামার ডাক পেয়ে আর দ্বিরুক্তি করেনি সে।
(চলবে)
"
শব্দমঞ্জরী একটি bengali literary blogzine.all about bengali story,poem, articale, mythology , novel, and many more.
আমদের এই ব্লগটি সাধারণত বাংলা সাহিত্য নিয়ে।
ConversionConversion EmoticonEmoticon