ধারাবাহিক উপন্যাস চতুর্থ কিস্তি
ভুল স্টেশনে নেমে
সমীরণ সরকার
আগামীকাল সকাল দশটায় ইন্টারভিউ। এখনো আশা আছে । ট্রেনটা যদি ঠিক মত চলে চলে আসে তাহলে ভোরের মধ্যে পৌঁছে যাবার কথা। অন্তত সহযাত্রী ভদ্রলোককে সেরকমই বলেছিলেন। আর যদি কোন কারনে বেশি লেট করে, তাহলে? না, আর ভাবতে পারছেনা পলাশ।
তাছাড়া সন্ধ্যাবেলায় তো পলাশ কে সঙ্গে নিয়ে বিমল মামার স্কুলের সেক্রেটারির বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল । সেই প্রোগ্রামটাও তো পন্ড হয়ে গেল। মোবাইলে চার্জ নেই। বিমল মামার সঙ্গে যোগাযোগ টাও তো করতে পারছে না। বাড়িতেও ফোন করতে পারছে না। কেন যে সকালবেলায় কলেজের বন্ধু মনোজের সঙ্গে অতক্ষণ ধরে কথা বলল পলাশ, তা সে নিজেই জানেনা।
কলেজ লাইফে মনোজ তো তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। যদিও প্রতিদ্বন্দিতা কখনোই আহ্বান করে নি পলাশ। প্রতিদ্বন্দিতা করার ইচ্ছেও ছিল না তার কোন কালে।
প্রতিদ্বন্দিতা? তাও কিনা একটা মেয়েকে কেন্দ্র করে? ভাবতেই পারেনা পলাশ ।আসলে চিরকালই বড্ড হিংসুটে আর পরশ্রীকাতর ছিল মনোজ। কলেজে ঢোকার প্রথম বছর থেকেই অ্যানুয়াল সোশ্যাল এ বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত সব ভাষাতেই কবিতা আবৃতি তে প্রথম স্থান টা বাধা ছিল পলাশের। তাছাড়া কলেজ স্যুভেনির এ কবিতা লেখা, সেকেন্ড ইয়ার থেকে সুভেনিয়র এর সম্পাদনার দায়িত্ব পাওয়া এ সমস্তই ঈর্ষার কারণ হয়েছিল মনোজের। অবশ্য এই কারণ গুলো ছিল গৌণ। মুখ্য কারণ ছিল ফার্স্ট ইয়ারের ববিতা। এটা অবশ্য অনেক পরে বুঝতে পেরেছিল পলাশ।
মনোজদের পাড়ার মেয়ে ববিতা। ডানা কাটা পরি না হলেও ববিতা বেশ সুশ্রী এবং আকর্ষণীয়া ছিল। সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ছিল ববিতার চোখ । যা ছিল ম্যাডাম সেনের মতো বাঙ্ময়। সেই ববিতা অন্ধ ভক্ত ছিল পলাশের কবিতার।
অবশ্য শুধু ববিতা নয়, ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড ইয়ারের অনেক ছেলে-মেয়ে পলাশের কবিতার গুনগ্রাহী ছিল। ক্লাসের অফ পিরিওডে মাঝেমাঝেই কলেজ মাঠের ঈশান কোণে মস্ত কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে গোল হয়ে বসে পলাশের কবিতা পড়া শুনতো সবাই। আর সেই দলের প্রধান উৎসাহী ছিল ববিতা। মনোজ ও থাকত সেই দলে, তবে নিয়মিত নয়, মাঝে মাঝে।
স্কুল লাইফ থেকেই ববিতার প্রতি অনুরক্ত ছিল মনোজ। স্কুলজীবনে দুজন আলাদা আলাদা স্কুলে পড়তো। কাজেই ববিতার প্রতি আকর্ষন বোধ করলেও সেভাবে খোলাখুলি তাকে কিছু বলার সুযোগ পায়নি মনোজ। দু-চারবার পাড়ার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ববিতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে গিয়ে পাত্তা পায়নি মনোজ।
ববিতার বাবা ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিক। কাজেই তার একমাত্র মেয়ে ববিতা পাড়ার মুদি দোকানের মালিকের ছেলে মনোজকে যে পাত্তা দেবে না ,এটাই স্বাভাবিক । এসমস্ত কথা মনোযোগ মুখেই শুনেছিল পলাশ।কলেজ জীবনে মনোজ যখন সেকেন্ড ইয়ারে পরে ওই কলেজেই ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হল ববিতা । মনোজ খুব উৎসাহিত হলো। হয়তো মনে মনে ভেবে নিল, এবারে ববিতার প্রতি দীর্ঘদিনের অনুচ্চারিত প্রেম নিবেদন করবে ।বাস্তবায়িত হবে দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ।কাজেই ববিতা যখন পলাশের কবিতার অন্ধ ভক্ত হয়ে উঠলো, মনোজ ঈর্ষান্বিত হলো। পলাশকে প্রতিদ্বন্দী ভাবতে শুরু করলো। পলাশ প্রথমদিকে ঠিক বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা। তার সঙ্গে মনোজের কথাবার্তার ধরন আচার-ব্যবহার সবটাই হঠাৎ যেন বদলে গেছিল। সে অবাক হলেও কিছুতেই বুঝতে পারছিল না কারণটা। শেষে সহপাঠী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু নিখিল ব্যাপারটা পরিস্কার করে দিল। তাকে জানিয়েছিল তার বান্ধবী ফার্স্ট ইয়ারের রমলা।
আসল কারণটা জানতে পেরে একদিন বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা মারার সময় সোজাসুজি মনোজকে চার্জ করল পলাশ। মনোজ প্রথমটায় স্বীকার করতে চায়নি কিছুতেই। শেষে নিখিল মুখ খুলতেই চুপ করে যায়। ঠিক এই সময়ে পূর্বপরিকল্পনা মত আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে রমলা আর ববিতা। ববিতা প্রচন্ড অপমান করে মনোজকে। মনোজ 'বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াতে চাইছে', সামান্য 'মুদি দোকানের মালিকের ছেলে হয়ে সিনিয়র ডব্লিউ বিসিএস অফিসার অলকেশ সেনের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করার সাহস পায় কি করে' ইত্যাদি অনেক অপমানজনক বাক্যের বিদ্ধ করে মনোজকে।
মনোজ কোন উত্তর দেয়না, নীরবে সব শোনে।
মাসখানেকের মধ্যেই মনোজ কলেজ থেকে টিসি নিয়ে চলে যায়। পরে জানা গেছিল যে, মনোজ তার পিসির বাড়ি গোবরডাঙ্গার ওখানে কোন কলেজে ভর্তি হয়েছে।
আস্তে আস্তে মনোজকে ভুলতে বসেছিল সবাই।
তাই আজ সকালে হঠাৎ মনোজের ফোন পেয়ে খুবই অবাক হয়েছিল পলাশ। ওই ভাবে হঠাৎ মনোজ টিসি নিয়ে চলে যাওয়ায় পলাশ দীর্ঘদিন অপরাধবোধে ভুগেছিল। তাই আজ হঠাৎ মনোজের ফোন পেয়ে পলাশ যুগপৎ বিস্মিত ও আনন্দিত হয়েছিল। ফোন ছাড়ার আগে মনোজের শেষ কথাটায় বিস্ময়ের চরমে পৌঁছে গেছিল পলাশ।
(চলবে)
পূর্ব প্রকাশিত অংশ গুলি পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
ConversionConversion EmoticonEmoticon