প্রবন্ধ
কবিতার শৈলী
কবিতার ভাষা, ব্যবহার , ছন্দ ও অলংকার
সৌম্য ঘোষ
শৈলীবিজ্ঞানের আলোচনা কখনো ভাষার আলোচনা ব্যতীত সম্পূর্ণ হতে পারেনা । কারণ যেকোন সাহিত্যের নির্মাণের প্রধান উপাদান হলো ভাষা । মুখের ভাষা , গদ্যের ভাষা এবং কবিতার ভাষার মধ্যে প্রভেদ অনেকখানি । গদ্যের ভাষা ও কবিতার ভাষার মধ্যেই পার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্ট । এর নেপথ্যে বেশকিছু ব্যাকরণগত কারণ রয়েছে অর্থাৎ বিশেষ্য ,বিশেষণ ,সর্বনাম ও ক্রিয়া ,অনুসর্গ প্রভৃতি ব্যবহারের বিশেষ ভূমিকা থেকে যায় । এই সমস্ত ক্ষেত্রে গদ্যের ভাষা থেকে কবিতার ভাষা আলাদা হয়ে যায়। বিশেষ্য পদের ক্ষেত্রে কবিতায় এমন কিছু শব্দের ব্যবহার আমরা দেখি যার চল গদ্যে নেই । যেমন, ভকতি , শকতি, মুকতি, যুকতি , পরাণ, নয়ান, তিয়াস , পিয়াস , মরম, জোছনা, বারতা, পূরব ইত্যাদি ইত্যাদি । বিশেষণের ক্ষেত্রেও কাব্যভাষায় কিছু স্বতন্ত্র রূপের অস্তিত্ব দেখতে পাই । যথা, আধো, আধেক, ম্লানো, মগন, বিভল, স্তবধ, পূরণ ইত্যাদি ইত্যাদি। সর্বনামের ক্ষেত্রে আমরা দেখি, মম, তব, মোদের, তারে, হেথা, হোথা, সেথা, তথা, যেথা প্রভৃতি শব্দ। ক্রিয়ার রূপের ক্ষেত্রে , কহা, রচা, হেরা, প্রবেশিয়া, নিমীলা, নিমীলি, ঝঙ্কারিয়া, নেহারি, তেয়াগি জাতীয় শব্দ। অনুসর্গের ক্ষেত্রে, পানে, সাথে, মাঝার, তরে, হতে, সনে, লাগে প্রভৃতি। ক্রিয়া-বিশেষণ এর ক্ষেত্রে আমরা দেখি, নিরবধি, অনুক্ষণ, সতত প্রভৃতি শব্দ। কেবলমাত্র শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রেই নয়, কবিতার ভাষা কাব্যিক হয়ে ওঠার নেপথ্যে কাব্যিক সমাস ব্যবহারের গুরুত্ব অনেকখানি । যেমন দেখি, আঁখিপাতা, আঁখিপাখি , হৃদয়যমুনা, মানবজমিন, ঘুমঘোর, অধরপুট, হৃদিমাঝে, তরুশাখা, মনপবণ আরো কত কি । এছাড়াও আমরা দেখি, একই পংক্তিতে ক্রিয়ার সাধু ও চলিত ভাষার ব্যবহার । যা কিনা গদ্যের ক্ষেত্রে গুরুচন্ডালী দোষরূপে বিবেচিত হয়।
কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে এই জাতীয় ব্যবহার দোষের হয় না বরং দ্যোতক হয়ে ওঠে । একটু দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টা বোধ হয় প্রাঞ্জল হয় ।
" বসন কার দেখিতে পাই জ্যোৎস্নালোকে লুণ্ঠিত
নয়ন কার নীরব নীল গগনে ।"
( 'কার' ........ 'দেখিতে' )
"ভরিয়া ওঠে নিখিল রতি বিলাপ সঙ্গীতে
সকল দিক কাঁদিয়া ওঠে আপনি ।"
( 'ভরিয়া উঠে'.......... 'কাঁদিয়া উঠে' )
"আসিয়াছে ফিরে
নিস্তব্ধ আশ্রম মাঝে ঋষিপুত্রগন ।"
( 'আসিয়াছে'/ 'ফিরে' )
"যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে ।"
( ' ঝরিয়া' / 'যাবো' )
------ উপরের কবিতার স্তবকগুলি কবিগুরুর লেখা।
এমন 'দ্যোত্যক' আপনি জীবনানন্দের কবিতায় অনেক পাবেন । উপরের দৃষ্টান্ত গুলির মধ্যে তৃতীয় দৃষ্টান্তে আছে একটি সমাপিকা ক্রিয়া এবং একটি অসমাপিকা ক্রিয়া । সমাপিকা ক্রিয়া টি সাধু, আবার অসমাপিকা ক্রিয়াটা চলিত । মান্য ভাষার নিয়ম অনুসারে এটি ব্যাকরণগত ভুল । এমন প্রয়োগ জীবনানন্দের পংক্তিতেও লক্ষ্য করা যায় । জীবনানন্দের একটি পংক্তি ------
" উড়ন্ত কীটের খেলা কতো দেখিয়াছি ।"
বাংলা কবিতায় সর্বনাম ও ক্রিয়া ক্ষেত্রে এরকম মিশ্ররীতির ব্যবহার আমরা দেখে থাকি ।
কাব্যিকতাই হল এই জাতীয় ব্যবহারের প্রধান শর্ত। কারণ কাব্যের সঙ্গে ছন্দের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ।
বিশিষ্ট কবিগন এইরূপ মিশ্র ব্যবহার করেন খেয়ালখুশি মতো নয় । ছন্দের শাসন মান্য করেই ।
কবিতায় এই জাতীয় ব্যবহারে কবির কোন প্রতিবন্ধকতা থাকে না বলেই কবিতার সৌন্দর্য অতি সহজে ফুটে ওঠে । কবিতা পাঠের সময়ও
শ্রুতিকটু মনে হয় না।
কবিতার শৈলী বিষয়ক আলোচনায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হলো ভাষার ব্যবহার । কবি সাহিত্যিক ভেদে ভাষার ব্যবহারও ভিন্ন হয় । আবার সময়ের আবহমানতায় আমরা ভাষার পরিবর্তন লক্ষ্য করি । প্রাক্-আধুনিক কবিদের সঙ্গে আধুনিক কবিদের শব্দের ব্যবহারে পার্থক্য চোখে পড়ে । কোন কোন কবি কবিতার স্বাতন্ত্র্য ও গাম্ভীর্য আনার জন্য তৎসম শব্দের ব্যবহার বেশি করেন । আবার কেউ কেউ লৌকিক শব্দের ব্যবহার পছন্দ করেন। কবিগুরু দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত শব্দ কখনোই কাব্যের জগতের সীমারেখায় প্রবেশ করতে দেননি । তাই তিনি বাঁশবনের পরিবর্তে বেনুবন লিখতেন। আবার প্রাত্যহিক জীবনের সজনেফুল, বকফুল এগুলিকে তাঁর কাব্যের জগতে প্রবেশাধিকার দেননি । বিপরীতক্রমে দেখুন, জীবনানন্দ দাশের কবিতায় লৌকিক শব্দের ছড়াছড়ি । সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ঝোঁক ছিল নিতান্ত অপরিচিত শব্দের দিকে । এমন হয় তাঁর কবিতা পাঠের সময় বাংলা অভিধান খুলে বসা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প থাকে না । কবিতার শৈলীর ক্ষেত্রে তৎসম, তদ্ভব, দেশি, বিদেশি ইত্যাদি শব্দের ব্যবহারের ক্ষেত্রে কবির বিশিষ্টতা পাঠকের নজরে আসে ।
কবিতার শৈলী বিচারের ক্ষেত্রে ছন্দ ও অলংকারের গুরুত্ব অপরিসীম । ছন্দ ও অলংকারের জন্য কবিতার ভাষা গদ্যের ভাষার থেকে স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে। গদ্যে কোন কোন সময়ে অলংকারের অল্প ব্যবহার থাকলেও ছন্দ একান্তভাবেই কাব্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। অলংকার যদিও কবিতার অপরিহার্য উপাদান নয়, তবুও খুব কম কবিতাতেই দেখা গেছে যেখানে অলংকারের ব্যবহার একেবারেই নেই । একথা প্রাক আধুনিক কবিতা থেকে আধুনিক কবিতা পর্যন্ত সমভাবে প্রযোজ্য ।
সমসাময়িক কালের আধুনিক বাংলা কবিতা অনেকটা গদ্যের কাছাকাছি চলে এলেও আজ পর্যন্ত ছন্দকে সম্পূর্ণ বর্জন করতে পারেনি । কবিতার ভাষা যে মান্য ভাষার তুলনায় অনেকাংশে বিচ্যুত সেটা আমরা জানি । আরএই বিচ্যুতির নেপথ্যে ছন্দের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কবিতার ভাষায় যে ধ্বনিগত সংবর্তনগুলি হয়ে থাকে , যথা,
ধ্বনি সংযোজন, ধ্বনি বিলোপন, ধ্বনি রূপান্তরণ
তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছন্দের কারণে । ছন্দের কারণেই গড়ে ওঠে কাব্যিক ভাষা । কবি জীবনানন্দ দাশের 'রূপসী বাংলা' কাব্যগ্রন্থে কবি মিশ্রকলাবৃত্ত রীতিতে মহাপায়ারের আশ্রয় নিয়েছেন । আবার সুকুমার রায় তাঁর 'সৎপাত্র' কবিতায় দলবৃত্ত ছন্দের আশ্রয় নিয়েছেন।
কবিতার শৈলী বিচারে আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অন্তমিল । সাহিত্য যখন ছাপাখানার দাক্ষিণ্য লাভ করেনি, তখন মানুষের স্মৃতিতে সাহিত্যকে হুবহু ধরে রাখার জন্য অন্ত মিলের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য । কারণ মিল স্মৃতি সহায়ক । এবং শ্রুতিরঞ্জকও বটে । ধ্বনি সাম্য যে শ্রুতিসুখ সৃষ্টি করে, তা সকলের মনে আনন্দের জাগরণ ঘটায়। একটি শিশু যখন প্রথম সাহিত্যের আস্বাদ গ্রহণ করে, তখন ছন্দ ও মিলবিন্যাসই তাকে ছড়া ও কবিতার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে । কবিগুরুর পংক্তির আশ্রয় নিলাম :
"কাল ছিল ডাল খালি
আজ ফুলে যায় ভরে
বল দেখি তুই মালী
হয় সে কেমন করে।"
ConversionConversion EmoticonEmoticon