[শুরু হল সমীরণ সরকারের ধারাবাহিক উপন্যাস "ভুল স্টেশনে নেমে "। নিয়মিত প্রকাশিত হবে সমীরণ সরকারের উপন্যাস ভুল স্টেশনে নেমে । নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজটি লাইক করুন https://www.facebook.com/shobdomanjori ]
ভুল স্টেশনে নেমে
সমীরণ সরকার
****************************** ***********
(এক)
ট্রেনটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়াতেই ঘুম ভেঙে গেল পলাশের। কামরার লাইটটা তেল কমে যাওয়া লণ্ঠনের মতই টিমটিমে। ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ গায়ে লাগতেই জামার গোটানো হাতাটা খুলে বোতাম আটকে দেয় পলাশ।
পলাশ যখন ট্রেনে উঠেছিল ,তখন ছিল ভ্যাপসা গরম। ট্রেনটা খুব ধীরগতিতে এগোচ্ছিল। তাই খুব একটা বাতাস লাগছিল না গায়ে। তাছাড়া ট্রেনটা যে মুখে চলছিল তার উল্টো দিকের সিটে বসার জায়গা পেয়েছিল পলাশ। তার উপরে আবার উল্টোদিকের জানালার ধারে পলাশের ঠিক মুখোমুখি যিনি বসেছিলেন, তিনি গায়ে-গতরে বেশ জুতসই। তিনি এমনভাবে তার মাথা এবং হাত জানলার সামনে আটকে দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাসের স্পর্শ অনুভব করছিলেন যে, কামরার বাকি প্যাসেঞ্জারদের অসুবিধা সম্পর্কে তিনি নিতান্তই উদাসীন ছিলেন। পলাশ এমনিতে খুব নির্বিরোধী এবং ভদ্র ছেলে। তাই বেশ অসুবিধা বোধ করলেও মুখ ফুটে কিছুই বলেনি সে সহযাত্রী কে।
চৈত্র শেষের সূর্যটা সারাদিন গনগনে তাপ বিকিরণ করেছে। ফলে ট্রেনের কামরা যথেষ্ট উত্তপ্ত । ট্রেনে যাত্রীর ভিড় আছে। প্যাসেঞ্জার ট্রেন । যখন যে স্টেশনে দাঁড়াচ্ছে, চট করে ছাড়ছেই না। হকারদের আনাগোনাও যথেষ্ট। সব মিলিয়ে কামরার ভিতরে একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ।
পলাশ অনুভব করতে পারছিল যে সে কুলকুল করে ঘামছে। গেঞ্জি ঘামে ভিজে সপসপ করছে। কপাল থেকে গড়িয়ে পড়া ঘাম চোখে পড়াতে চোখ জ্বালা করছে। পলাশ তার উল্টো দিকের যাত্রীকে কিছু বলবে বলবে ভেবে বারবার ওই দিকে তাকিয়েও শেষ পর্যন্ত কিছু বলতে পারছিল না নিতান্ত ভদ্রতাবোধে।দএমনিভাবে কিছুটা সময় কাটে। আরো দুই একটা স্টেশন পেরিয়ে যায়।
নাঃ! আর সহ্য হচ্ছে না। পলাশ তার উল্টো দিকে বসা যাত্রী র উদ্দেশ্যে বলে," ও দাদা, মাথাটাএকটু সরান না।"
উল্টো দিক থেকে কোন জবাব নেই। মাথা সরিয়ে সোজা হয়ে বসার মতো কোনো ইচ্ছাই যেন নেই তার। বারকয়েক অনুরোধ করার পরেও কোন সাড়া না পেয়ে পলাশ এবার একটু উঁচু স্বরেই বলে, ও দাদা, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন না যে আপনাকে মাথাটা সরাতে বলছি? আপনার জন্য তো সবারই অসুবিধা হচ্ছে।
এবার নড়েচড়ে বসেন ভদ্রলোক। হাতের উপর থেকে মাথাটা তুলে তিনি পলাশের দিকে এমন তাচ্ছিল্য এবং রাগত দৃষ্টিতে তাকালেন যে মনে হল পলাশ কথাটা বলে যেন মস্ত বড় অপরাধ করেছে।
এবারে রেগে যায় পলাশ। তার স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে একটু উঁচু স্বরে রাগতভাবে বলে, আচ্ছা মানুষ তো মশাই আপনি। নিজে অপরাধ করেছেন অথচ ভাবটা এমন করছেন যে, ,আপনাকে মাথাটা সরাতে বলে অপরাধ টা যেন আমি করেছি।
--- অপরাধ? কি অপরাধ করেছি আমি ?আমার সিটের পাশের জানালায় মাথা নামিয়ে রাখার অধিকার আমার আছে!
----- না, নেই। জানলাটা আপনার সিটের পাশে হলেও ওইটা ওই ভাবে আপনি আটকে রাখতে পারেন না।
------ কোন আইনে বলা আছে এই কথা?
------ আরে, আচ্ছা মানুষ তো আপনি ! খামোখা তর্ক করছেন। আপনি ওভাবে মাথা নামিয়ে রাখলে কামরায় হাওয়া ঢুকবে না। আমার একা শুধু নয়, সব যাত্রীর অসুবিধা হবে।
----- আর তো কেউ কিছু বলছে না।শুধু আপনি ঝামেলা পাকাচ্ছেন কেন?
কামরার অনেক যাত্রী এতক্ষণ মন দিয়ে পলাশ ও ওই মোটা ভদ্রলোকের বাদানুবাদ মন দিয়ে শুনছিল। হঠাৎ তাদের মধ্য থেকে একটি দাড়িওয়ালা যুবক এগিয়ে এসে বলল, ঝামেলা তো আপনি করছেন। এই দাদা তো ঠিকই বলেছেন, এই প্রচন্ড গরমের মধ্যে ওভাবে জানালাটা আটকে রাখলে সবারই অসুবিধা হবে।
মোটা লোকটি এবারে একটু ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বলে উঠলো, আহা এলেন এবার শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল!
---- কি বললেন?
----- হচ্ছিল আমাদের দুজনের মধ্যে কথা,আপনাকে দালালি করতে কে বলল?
দাড়িওলা যুবকটি কিছু উত্তর দেবার আগেই হঠাৎ দশ-বারোটি যুবক প্রায় রে রে করে তেড়ে এল মোটা লোকটির দিকে। তাদের মধ্যে একজন মোটা লোকটির সামনে গিয়ে বেশ রাগতস্বরে বলে উঠলো, এইযে মোটুরাম, যা বললে ওইকথা আরেকবার উচ্চারণ করলে এক থাপ্পড়ে থোবড়া বিগড়ে দেবো ।
------এই এই, হচ্ছেটা কী! তোমরা আমাকে মারবে নাকি?
----- মারবো মানে,এইসা মার দেব যে ঘরে তোর বৌ চিনতে পারবে না তোকে।
------ তুই তোকারি করছো কেন?
------ বেশ করেছি তুই-তোকারি করেছি। তোর এত সাহস যে তুই অশোকদাকে দালাল বলছিস! তুই জানিস অশোকদা কে?
মোটা লোকটি কিছু বলার আগেই এবার একজন পলিত কেশ ব্যক্তি তাঁর সিট ছেড়ে এগিয়ে এসে কলহরত যুবকটিকে বলেন, এসব ঝামেলা এখন বন্ধ কর প্রদীপ। একটু পরে মাঠে নামতে হবে তোদের। আজ ফাইনাল ম্যাচ। এখন মাইন্ড কনসেনট্রেট না করলে খেলায় ভুল হবে। যা ,সরে যা এখান থেকে।
যুবক গুলো বিনা বাক্য ব্যয়ে সরে যায় ওখান থেকে। বৃদ্ধও গিয়ে বসেন নিজের সীটে। একটা খবরের কাগজ মেলে ধরেন চোখের সামনে।
কিছুক্ষণ পরে পরবর্তী স্টেশন এলে নেমে যায় যুবকগুলো ও ওই বৃদ্ধ ভদ্রলোক। আর ঠিক পরের স্টেশনেই নেমে যায় ওই মোটা লোকটিও।
পলাশ এবারে উঠে গিয়ে বসে জানালার ধারে ওই ভদ্রলোকের ছেড়ে যাওয়া সিটে। জানালার ধারে ঠাণ্ডা হাওয়ায় এবার একটু আরাম বোধ করে সে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই 'মধ্যদিনের রক্তনয়ন অন্ধ' করে সূচনা হয় কালবৈশাখীর। আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ঝলসে ওঠে ক্ষণপ্রভা।
ধুলোর ঝড় ওঠে। অন্ধকার হয়ে যায় চতুর্দিক।
একটু পরেই মুহুর্মুহু মেঘের গর্জন এর সঙ্গে শুরু হয়ে যায় বৃষ্টি। ঠাণ্ডা বাতাসের স্পর্শে দুচোখ বুজে আসে পলাশের।
(চলবে)
****************************** ***********
ConversionConversion EmoticonEmoticon