টেরিলিনের শার্ট
সমাজ বসু
টাইয়ের নটটা বাঁধতে বাঁধতেই দরজা
খুলল অলীক।
--- আরে,কালী দা তুমি! এসো এসো, ভেতরে এসো। সাড়ে তিন বছর
পর তোমায় দেখলাম। অলীকের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর কালী
দা মুখ খুলল।
--- তুমি বুঝি অফিস যাচ্ছ? সেই বিদেশে যাবার আগে তোমার
সাথে দেখা হয়েছিল,তারপর এই আজ। কথার ফাঁকে কালী দার চোখ চলে যায়
দেওয়ালে টাঙানো ছবিতে।
---একি, সাহেব নেই? কবে চলে গেলেন?
--- এই তো বছর দুয়েক হলো। মা একা, তাই
কলকাতায় ফিরে এলাম। এখানে আসার পর নানান কাজে ব্যাস্ত থাকায় আর দেখা
করতে পারিনি।
--- না, না সে ঠিক আছে। সাহেবের কি হয়েছিল?
--- আসলে কি জানো তো, তোমার জেলে যাবার পর থেকেই বাপি কেমন
মুষড়ে পড়েছিল। কোন কাজে মন ছিল না। সাইটে যেতে হয় তাই যেত। অফিস থেকে
ফিরে সব কথা হবে। তোমাকে আজ থাকতে হবে কিন্তু কালী দা।
কালী দার সব আপত্তি নাকচ করে,তাকে মায়ের জিম্মায়
ছেড়ে অলীক বেড়িয়ে পড়ল।
কালী মজুমদার অলীকদের প্রায় তিরিশ বছরের
পুরনো বিশ্বস্ত ড্রাইভার। অলীকের বাবা, সৌগত রায় এই কালী দাকে সঙ্গে
নিয়েই আলিপুর শো রুম থেকে জীবনে প্রথম গাড়ি কিনেছিলেন। আম্বাসাডার।
হালকা নীল রঙটা কালী দাই পছন্দ করেছিল। সৌগত বাবু কালী দাকে খুব বিশ্বাস
করতেন। কালি দাও সাহেব বলতে অজ্ঞান। কালী দা এই বাড়ির শুধু ড্রাইভারই
নয়,সদস্যও বটে। সৌগত বাবুকে ব্যাবসার প্রয়োজনে প্রায়শ কলকাতার বাইরে
থাকতে হতো। বাড়ির সব ঝক্কিঝামেলা কালী দাই সামলেছে। একটু বড় হতেই
অলীকের যত আবদার কালী দার কাছেই।
--- শোনো কালী,বাপ্পাকে(অলীকের ডাক নাম)আশকারা দিয়ে
মাথায় তুলো না। যা চাইবে সঙ্গে সঙ্গে কিনে দেবে না।
--- সাহেব,ও আপনি ভাববেন না। বাপ্পা আমার কোলেপিঠেই
বড় হচ্ছে, তাই ওর দু একটা বায়না রাখি।
--- সেইজন্যই তো ও সবসময় তোমাকেই চায়। এখন থেকে
ভাবছি তোমার মাইনেটা একটু বাড়াতে হবে। তুমি যে হারে বাপ্পার জন্য খরচ
করছ,তাতে তোমার হাতে টাকা তো থাকেই না।
এইরকম আকাশের মত মন ছিল সাহেবের। সৌগত বাবুর
কথা মনে পড়তেই চোখ দুটো ভিজে কালী দার। মানুষটার অগাধ বিশ্বাস ছিল তার
ওপর। অমন সুন্দর একটা মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া সেই দিনটার দুর্ঘটনায়
দুবার ভাবেনি সে।
--- সাহেব,আজ এই অবস্থায় আপনাকে আমি কিছুতেই গাড়ি
চালাতে দেব না।
-- তোমার কোন ভয় নেই কালী। আমি ঠিক চালিয়ে নিয়ে
যাবো। কেন তোমার মনে নেই, তুমি অসুস্থতার জন্য দিন পনেরো আসোনি,আমি
দিব্যি চালিয়েছিলাম।
সাহেবের এই একটা অভ্যাস ছিল। সপ্তাহের শেষে
তার বারে যাওয়া চাই। সেইদিন সব কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। বার
থেকে বেরিয়েই সাহেবের জেদ শুরু হয়েছিল। রীতিমত অপ্রকৃতিস্থ মানুষটার
জেদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল তাকে।
তখন রাস্তায় এত সিগন্যাল ছিল না। রাত দশটার
পর ট্রাফিক পুলিশও উধাও হয়ে যেত। আম্বাসাডারের পিকআপ ঠিকই ছিল। হঠাৎ যেন
একটা তীব্র আলোর ঝলকানি সাহেবের মুখে এসে পড়তেই, সেই দুর্ঘটনা। রাস্তার
ধারে ছোট একটা বন্ধ চায়ের দোকান ঘেঁষা ল্যাম্পপোস্টের ধাক্কায় সব দৃশ্য
স্তব্দ। স্টিয়ারিইং এ সাহেবের মাথা। কালী দার আজ সবকিছু নতুন করে মনে
পড়ছে।
কিছুক্ষণ পর কালী দা ঘাটালে নিজের
বাড়িতে ফিরে যাবে। চায়ের পাট শেষ হতেই অলীকের হাতে একটা ছোট
প্যাকেট তুলে দেয় কালী দা।
--- বাপ্পা তোমার মনে আছে, তোমার চাকরির প্রথম
টাকায় তুমি সাহেবকে একটা টেরিলিনের শার্ট দিয়েছিলে? কালী দার প্রশ্ন
অলীককে ধাঁধায় ফেলে। প্যাকেট খুলতে খুলতেই অলীক জিজ্ঞেস করে, কিন্তু এত
বছর পর হঠাৎ সেই জামার কথা? প্যাকেট থেকে জামাটা বের করে অবাক হয়ে
যায় অলীক।
--- একি! এ তো বাপির সেই জামাটাই। তোমার কাছে গেল
কিভাবে? জামার ভাঁজ খুলতেই অলীকের আরো একবার বিষ্ময়ের পালা। ডান দিকে
কাঁধের কাছে রক্তের দাগ,যা ধোওয়ার পরেও যায়নি।
--- কালী দা,এই জামাটাই কি বাপি সেদিন পরেছিল? আমার
মনে হয় তুমি কিছু একটা লুকোচ্ছ।
--- আরে না, কিছুই লুকোচ্ছি না। সাহেব কে দেওয়া তোমার
উপহারটা ফিরিয়ে দিতে এলাম। কালী দা সত্যিটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে।
--- কালী দা,আজ তোমাকে সত্যি বলতে হবে। অলীক কালী
দার
ডান হাতটা নিজের মাথায় টেনে আনে।
--- একি করছ বাপ্পা।
--- দ্যাখো কালী দা,আজ আর সেই আম্বাসাডার নেই। বাপিও নেই।
অহেতুক সত্যিটা গোপন রেখে, কষ্ট পেও না। আজ তোমাকে সব বলতেই হবে।
অলীকের কথায় কালী দা কিছুক্ষণ নির্বাক থাকার পর নীরবতা
ভাঙে।
--- সত্যিটা কি জানতেই হবে? কালী দা প্রশ্ন ছুঁড়ে
দেয় অলীককে।
--- কালী দা আমাদের পরিবারের তুমি একজন সক্রিয়
সদস্য ছিলে,আছো এবং থাকবে। মা আর বাপির মতই তুমিও আমাকে স্নেহ দিয়েছ।
আমি কিছুই ভুলিনি। কাজেই তোমার ব্যাক্তিগত কথা জানার অধিকার আমার আছে।
অলীকের বিশ্বস্ত স্বীকৃতির কাছে কালী দাকে হার মানতে
হয়।
--- আমি বহুদিন সাহেবের নুন খেয়েছি।তাই ভেবেছিলাম,নুনের
দাম ফিরিয়ে দিতে হবে।তাই বিন্দুমাত্র দেরি না করে,সেইদিন তোমার বাপির এই
রক্তমাখা টেরিলিনের শার্টটা গায়ে দিয়ে,সাহেবকে অপরাধের হাত থেকে
বাঁচিয়ে আমি আমার পবিত্র কর্তব্য পালন করেছিলাম।
কালী দার কথা শুনে অলীক হতভম্ব হয়ে যায়।
বিষ্ময়ের জাল তাকে বেঁধে ফেলে। কালী দার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে
থাকে সে। একজন মানুষ শুধু মনিব ও তার পরিবারের স্বার্থে, নিজের জীবনের
অমূল্য কয়েকটা বছর বিসর্জন দিতে পারে,সে ঈশ্বর না হয়ে মানুষ হতে পারে
না।
একসময় কালী দাকে জড়িয়ে বাচ্চা ছেলের মত ডুকরে ওঠে অলীক।
আর কালী দা তার আদরের বাপ্পার মাথায় স্নেহের হাত রাখে।
ConversionConversion EmoticonEmoticon