bangla choto golpo mondakini/বাংলা ছোট গল্প মন্দাকিনী

bangla_choto_golpo_mondakini/বাংলা_ছোট_গল্প_মন্দাকিনী


* মন্দাকিনী *

  চিন্ময় মহান্তী

প্রথম পরিচ্ছেদ 


দীর্ঘদিন হইল লেখালেখির সহিত আমার সখ্যতা ম্লান হইয়া আসিয়াছে। অদ্য তাহার সহিত করমর্দনের উদ্দেশ্যে লেখনী হাতে চিরপরিচিত সেই চৌকিটিতে বসিলাম। যাহার জীবন কাহিনী বর্ণনা করিব তাহার নাম ভিন্ন হইলেও আমি তাহাকে এস্থলে মন্দাকিনী নাম প্রদান করিলাম। যাহা হোউক মন্দাকিনীর জীবন সুখ - দুঃখ , হীরা - পান্না , গলিত মুক্তায় যেভাবে পূর্ণ হইয়াছিল তাহার কিঞ্চিৎ আমি অবগত ছিলাম। কিন্তু কল্য মন্দাকিনীর এক বন্ধুর মুখ হইতে বিস্তারিত শুনিয়া , গলিত মুক্তার প্রভাবের প্রধান্য শুনিয়া , হৃদয় অল্প বিস্তর বিচলিত হইল। আমার হৃদয় বিচলিত হইবার একটাই কারণ তাহাকে আমি খুব ছোটোবেলা হইতে চিনিতাম। ইহার পর ভূমিকার ঘনঘটা ছাড়িয়া মূল ঘটনায় আসি। 

                 সেদিন গোধূলির রাঙা আলো গায়ে মাখিয়া মন্দাকিনী ধীরে ধীরে বড় হইয়া উঠিতেছিল। তাহার রূপ লাবণ্য তাহারই সখী মহলে হিংসার জন্ম দিতেছিল। তাহার অধিক রূপ লাবণ্যের কারণে সদ্য প্রেম জাগরূক যুবা হৃদয়ে মন্দাকিনীর জন্য একটি প্রেম উদ্যানের জন্ম হইয়া তাহাতে গোলাপের সুবাস ছাড়িয়া বসন্তের কোকিল কুহুতানে ডাকিতে আরম্ভ করিয়াছিল। মন্দাকিনী নিজের মাহাত্য সম্পর্কে তখনও বিশেষ অবগত হয় নাই। ইহা তাহার মনের সারল্যের কারণে ঘটিয়াছিল। সে অতীব সাধারণ ভাবিয়া যার তার সহিত ভাব জমাইয়া গল্প করিত। মন্দাকিনী তখনও বোঝে নাই তাহার এই শিশুসুলভ আচরণের নিমিত্ত ভবিষ্যতে এক কঠিন পরীক্ষার মুখাপেক্ষী হইতে হইবে। সমালোচনার দুর্ভেদ্য কাঁটাতারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াইয়া অনাবশ্যক আগন্তুক ভাঁটার স্রোতে জীবন বৈতরনী টানিটে হইবে। মনুষ্যই যে মনুষ্যকে সর্বাধিক বিপদ সম্মুখীন করিয়া তোলে তাহা বুঝিবার ক্ষমতা অপরিপক্ব মস্তিষ্কে তখনও হইয়া ওঠে নাই। 
     
           মন্দাকিনী সবে ষোড়শী হইয়াছে। সর্বদা যে পথ দিয়া সে স্কুল কিম্বা টিউশন যায় সেই পথে একটি মেসবাড়ী রহিয়াছে যাহার নাম যতদূর মনে পড়িতেছে অবনীবাস হইবে। অবনীবাসের কতিপয় কলেজ ছাত্রের মধ্যে অমৃত নাম ধারী একটি ছাত্র অন্তরে অন্তরে মন্দাকিনীর প্রতি একটি টান অনুভব করিত কিন্তু মন্দাকিনী ইহা জানিতে পারে নাই। প্রত্যহ মন্দাকিনী কখন সেই রাস্তা দিয়া যাইবে তাহা অমৃতের পদ্যের ন্যয় মুখস্থ হইয়া গিয়াছিল। মন্দাকিনী যে ইহা অবগত হইবে না তাহা সে কখনো ভাবে নাই। কোনো একদিন ঘটনাচক্রে সে জানিতে পারিল মন্দাকিনী তাহার সম্পর্কে বিন্দুমাত্রও অবগত নহে। ইহা জানিয়া অমৃত স্থির করিল কোনোক্রমে তাহাকে জানাইতে হইবে। মন্দাকিনী সম্পর্কে তাহার হৃদয়ে যে একটি পদ্ম পুষ্করিণীর জন্ম হইয়াছে ইহা কি করিয়া  তাহাকে জানাইবে ভাবিয়া অমৃত বিচলিত হইয়া উঠিল। তাহার দোলার ন্যয় দোদুল্যমান হৃদয়ের প্রকাশ চোখে মুখে ফুটিয়া উঠিল , ইহা অন্যান্য আবাসিক ছাত্রদের দৃষ্টির অগোচর রহিল না । এক্ষনে তাহার বহু উপদেশ দাতা - পরামর্শ দাতা বাহির হইয়া পড়িল। কেহ কেহ তদুপরি অগ্রসর হইয়া বলিল, " অমৃত তুই চিন্তা করিস না মন্দাকিনীর এক বান্ধবী আছে আমার পরিচিত তাকে দিয়ে বলা করাবো।'' অমৃত কিঞ্চিৎ চিন্তা করিয়া অধিক অগ্রসর বন্ধুটির পথ শ্রেয় বলিয়া স্থির করিল এবং তাহাতে রাজি হইয়া গেল। যাহা হোউক অল্প কয়েকদিনের মধ্যে সুযোগ বুঝিয়া অমৃতের বন্ধুটি মন্দাকিনীর বান্ধবীর সহিত দেখা করিয়া তাহাকে সমস্ত বিষয় অবগত করাইয়া বলিল , '' দেখ মধুমিতা তুই একটু মন্দাকিনীকে বুঝিয়ে বল , নইলে অমৃত ...,'' মধুমিতা পলাশের কথাটি অসমাপ্ত রাখিয়া বলিল ," ঠিক আছে আমি তো বলবো আর যতটা সম্ভব সাহায্য করবো বিনিময়ে আমি কি পাবো ?'' এস্থলে মধুমিতা তাহার লাভের অঙ্কটি বুঝিয়া লইল। বিস্তর উপঢৌকন লাভ করিতে আরম্ভ করিল। মন্দাকিনীর সহিত চলিতে ফিরিতে সর্বদা সে অমৃতের প্রসঙ্গ লইয়া বলিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু মন্দাকিনী ইহার আভ্যন্তরীণ লাভ লোকসান বিষয়টি সম্পূর্ণ অজ্ঞাত রহিল। তাহার কর্ণকুহরে অমৃত নামটি সর্বদা বাজিতে লাগিল। তাহার মনে অজ্ঞাতেই একটি সহানূভূতির সৃষ্টি হইল। সে  অমৃতকে দেখিলেই কিঞ্চিৎ বাক্যালাপ করিতে আরম্ভ করিল। ইহা যে ভালবাসা নহে শুধুমাত্র সহানুভূতি তাহা অমৃত বুঝিতে অপারগ হইল। ক্রমশ তাহার মনে হইতে লাগিল সে ইহ জগতের শ্রেষ্ঠা নারী রত্নটি লাভ করিয়াছে। ইহা যে তাহার মানসিক বিভ্রান্তি তাহা বুঝাইতে কেহ তথায় উপস্থিত রহে নাই। সে নানা বিধ উপঢৌকনে তাহার মানসি মূর্তিটিকে সাজাইতে আরম্ভ করিল।          

             আকস্মিক ঘূর্ণিঝড় উঠিলে পাল ছিড়িয়া যেরূপ বৈঠা দিকভ্রান্ত হইয়া যায় একদিন মধুমিতার মুখ হইতে সংবাদটি শুনিয়া অমৃতের নিজেকে সেই দিকভ্রান্ত বৈঠার ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। মধুমিতা সাইকেল লইয়া কোনো এক কার্যে অবনীবাসে নিকটের পথ দিয়া যাইতেছিল , অমৃত ছাদে পায়চারি করিতেছিল ; সবে রক্তিম সূর্য তাহার বর্ণ পরিবর্তন করিয়া একটি তপোৎপাদক গোলকে পরিণত হইতেছিল। অবনীবাসের উঠানের রজনীগন্ধাগুলো তাহাদের সুঘ্রাণ ছড়াইয়া ক্লান্ত হইয়া দিবানিদ্রার প্রস্তুতি শুরু করিয়া দিয়াছিল। মধুমিতা ইঙ্গিতে অমৃতকে ডাকিয়া বলিল , '' কয়েকদিন ধরে দেখছি একটি ছেলে মন্দাকিনীর কাছে প্রেম প্রস্তাব রাখছে। তবে আমি ওকে বুঝিয়েছি যে এসব না করতে , ওর থেকে ছেলেটাকে দূরেই সরিয়ে রাখছি ।" অমৃত ইহা শুনিয়া খুশি হইয়া মধুমিতাকে উপহার প্রদান করিবার প্রস্তাব করিল। মধুমিতা চলিয়া গেল কিন্তু অমৃত-র মন হইতে দৃঢ়তা যেন এক মূহুর্তে কোথায় বিলীন হইয়া গেল। নাউ মাঝ দরিয়ার অতল গভীরে ডুবিবার ভয়ে সে ছেলেটির খোঁজখবর আরম্ভ করিল। খোঁজ মিলিয়া গেল,  ছেলেটি আর কেহ নহে তাহারই কলেজে পড়ে শুভ্র । সে অন্য একটি মেসবাড়ীতে ভাড়ায় থাকিয়া পড়াশোনা করিতেছে । কি করিবে কি করিয়া শুভ্র কে বিরত করিবে ইহা ভাবিয়া অমৃত-র মস্তিষ্কে একটি পাহাড় প্রমাণ চিন্তার বোঝা চাপিয়া গেল। 
    
            এক গোধূলি মাখা বিকেলে সে শুভ্র-র নিকটে ছুটিয়া গেল , শুভ্র তখন একটি আরাম কেদারায় বসিয়া দুলিয়া দুলিয়া "পথের পাঁচালী "-র অন্তিম অংশটি পড়িতেছিল। অমৃতকে দেখিয়া ব্যাপার বুঝিতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হইল না , শুভ্র নিকটস্থ তক্তপোশটি দেখাইয়া অমৃতকে বসিতে বলিল কিন্তু অমৃত বসিল না সে সরাসরি প্রসঙ্গে আসিয়া বলিল," শুভ্র তুমি কি মন্দাকিনীকে ভালোবাসো ? " শুভ্র উপন্যাসটি বন্ধ করিয়া অমৃত-র মুখপানে চাহিয়া বলিল," এতে কি কোনো সন্দেহ আছে!" খানিকক্ষণ নিশ্চুপ থাকিয়া অমৃত বলিল," তুমি জানো ওকে আমি কতটা ভালোবাসি , ওর পিছনে কত টাকা খরচ করেছি ; তুমি সরে যাও ।" কথাগুলি শুনিয়া শুভ্র কিঞ্চিৎ চড়া গলায় বলিল ,"  তুমি টাকা খরচ করেছো বলে আর কারো ভালোবাসা চলবে না , আমার ভালোবাসা কি ফ্যালনা! যাও যাও তুমি ওকে মোটেই ভালোবাসো না। টাকার মোহে ফেলে ওকে পেতে চাইছো , এটা তোমার ভালোবাসা নয় ওর সৌন্দর্য্যের প্রতি তোমার কামুক চাহিদা।" শুভ্র-র কথা শেষ হইতে না হইতেই অমৃত ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। শুভ্র পুনরায় উপন্যাসটি খুলিয়া পড়িতে লাগিল।

           উপরিউক্ত ঘটনার পর শুভ্র অনেকবার চেষ্টা করিয়াছে মন্দাকিনীর সহিত কথা বলিবার কিন্তু মন্দাকিনী শুভ্র-র সহিত কথা বলা তো দূর রাগ দেখাইয়া তাড়াইয়া দিয়াছে। ইহার মূলে একজনের ভূমিকা সর্বপরি কাজ করিয়াছে সে মধুমিতা। কিঞ্চিৎ উপঢৌকণের লোভে মন্দাকিনী হইতে শুভ্রকে দূরে সরাইবার জন্য অতি সুকৌশলে একটি বিষবৃক্ষ রোপণ করিয়া দিয়াছে ইহা মন্দাকিনী বোঝে নাই , মন্দাকিনী যে প্রকৃত ভালোবাসা হইতে বঞ্চিত রহিল তাহা বিন্দুমাত্রও উপলব্ধি করিতে পারিল না। সে অর্থ সর্বস্ব ভালোবাসার নিকট সাময়িক নতি স্বীকার করিল। শুভ্র মনস্থির করিল এইরূপে তাহার ভালোবাসাকে সে পাইবে না , জীবনে প্রতিস্ঠিত হইয়া মন্দাকিনীর পিতার নিকট গিয়া তাহার ভালোবাসাকে চাহিয়া লইবে। কিন্তু মন্দ ভাগ্য যখন আসিয়া উপস্থিত হয় তখন বোধ হয় তাহা প্রতিরোধ করা জটিল হইয়া ওঠে। শুভ্র উচ্চ শিক্ষার নিমিত্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইয়া গেল। মন্দাকিনী ইহার বিন্দুবিসর্গও জানিতে পারিল না । আপন মনে মন্দাকিনীর জন্য একটি রত্ন খচিত আসন নির্মাণ করিয়া শুভ্র লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করিল।

          মন্দাকিনী তখন অমৃতের স্বপ্নে বিভোর হইয়া সবে মন মধ্যে একটি রাজপ্রাসাদের অবয়ব স্থাপন করিয়া তাহারেই রানি সাজিয়া বসিয়াছে। অমৃত-র কলেজের পাঠ সমাপ্ত হইল , সে বাড়ী চলিয়া গেল। মন্দাকিনীর সহিত ফোনে বাক্যালাপ হইতে লাগিল। অমৃত-র সহিত ঘর বাঁধিবার একবুক স্বপ্ন লইয়া মন্দাকিনী দিন গুনিতে লাগিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন অচিরেই বিনষ্ট হইল। অমৃত-র সহিত ফোনে বাক্যালাপ তলানিতে আসিয়া পড়িল। তাহার দিক হইতে বিবাহ সম্পর্কিত কোনো রূপ অগ্রগতি দেখিতে না পাইয়া মন্দাকিনী হতাশ হইয়া পড়িল এবং ক্রমান্নয়ে যেটুকু তলানি অবশিষ্ট রহিয়াছিল তাহাও একদিন নিঃশেষ হইল। বেকারের পদক বুকে ঝুলাইয়া মন্দাকিনীকে বিবাহ করিবার সাহস দেখানো অমৃত-র পক্ষে সম্ভব হইল না।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 


               গ্রীষ্ম কাটিয়া শীত আসিয়া পড়িল সকল বান্ধবী মিলিয়া স্থির করিল বনভোজনের জন্য শুশুনিয়া যাইবে। এক কুয়াশা মাখা ভোরে সকল বান্ধবীদের সহিত মন্দাকিনী বাহির হইল । তখন কি বুঝিয়াছিল ইহাই তাহার জীবনকে এক কণ্টকময় পথে লইয়া যাইবে , যদি বুঝিত তাহা হইলে হয়তো সেইদিন যাইত না। শুশুনিয়া বেড়াইতে আসা এক যুবকের সহিত মন্দাকিনীর পরিচয় হইয়া গেল। যদিও পরিচয়ের ব্যাপারে যুবকটিরই অধিক আগ্রহ প্রকাশ লক্ষিত হইয়াছিল। মন্দাকিনীর রূপ লাবণ্য দেখিয়া তাহার মন মধ্যে লালসার শিখাটি দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিয়াছিল। মন্দাকিনীর সারল্য ইহা বোঝে নাই , সে বন্ধু ভাবিয়া পরিচয় করিয়া লইল। আর এই পরিচয় যে একদিন তাহার সর্বজীবনের পরিচয় হইবে বুঝিল না। বনভোজন শেষ করিয়া সকলে ফিরিয়া আসিল। ইহার পর মন্দাকিনীর জীবনের গল্প দ্রুত অগ্রসর হইল ।

           সবে সকাল হইয়াছে মন্দাকিনী মামা বাড়ী  হইতে বাড়ী ফিরিবে বলিয়া বাস ধরিল , খানিকটা রাস্তা সেই বাসে আসিয়া অন্য একটি বাস ধরিবে বলিয়া অপেক্ষা করিতেছিল ; হঠাত্‍ কোথা হইতে অমলেশ আসিয়া পড়িল। আপনারা হয়তো ভাবিতেছেন অমলেশ কে ? তাহার পরিচয় অল্প আগেই দিয়াছি সেই যুবকটি যাহার সহিত শুশুনিয়াতে মন্দাকিনীর পরিচয় হইয়াছিল । অমলেশ মন্দাকিনীকে ডাকিয়া লইয়া বিশ্রামাগারে বসিল। একটির পর একটি গল্প আরম্ভ করিয়া অতি সুকৌশলে মন্দাকিনীকে আটকাইয়া রাখিল। ইহার মধ্যেই দুজনের মধ্যে ফোন নম্বর বিনিময় হইল। কিন্তু মন্দাকিনীর নিকট কোনো ফোন রহে নাই। দুপুর গড়াইয়া বিকাল হইয়া গেল মন্দাকিনী ভাবিল শেষ বাসটা ধরিয়া বাড়ী চলিয়া যাইবে। অমলেশের প্রতি যে তাহার ভালোবাসা জন্মিয়াছে ইহা নহে অধিক সারল্য ইহার জন্য দায়ী। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হইয়াছে , মন্দাকিনী আসে নাই দেখিয়া তাহার বাবা শ্বশুর বাড়িতে ফোন করিয়া জানিতে পারিলেন সেই কোন সকালে মন্দাকিনী বাহির হইয়াছে। তাহার বাবা দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া গ্রামের কয়েকজনকে ডাকিয়া ঘটনা বলিয়া খুঁজিতে যাইবেন মনস্থির করিলেন। গ্রামের মধ্যে একটি শোরগোল পড়িয়া গেল। সকলের মুখে মুখে ঘুরিতে লাগিল , " মন্দাকিনী ঘর ছেড়ে পালিয়েছে ।" 
           
          কি মনে হইল বলিতে পারিব না , মন্দাকিনী অমলেশের ফোনটি লইয়া তাহার বাবাকে ফোন করিল। বাবা বলিলেন, " আমি সব আত্মীয় ঘরে ফোন করে খবর নিয়েছি । গোটা গ্রামে ছিঃ ছিঃ পড়ে গেছে!" মন্দাকিনী কাঁদিতে কাঁদিতে ফোনের অপর প্রান্ত হইতে বলিল," বাবা তুমি আমাকে নিতে এসো আমি আর একা বাড়ী যেতে পারবো না!" 
" ঠিক আছে" বলিয়া তাহার বাবা গাড়ি লইয়া মেয়েকে আনিতে বাহির হইয়া গেলেন। যখন মন্দাকিনী গ্রামে ঢুকিল তখন অনেক রাত্রি হইয়াছে। গ্রামে একটি নিস্তব্ধ পরিবেশ বিরাজ করিতেছে। দুই চারিটি সারমেয় থাকিয়া থাকিয়া চিৎকার করিয়া উঠিতেছে ।
            
          সকাল হইয়াছে মন্দাকিনী নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করিয়া বাড়ীর বারান্দায় বসিয়া আছে। সামনের রাস্তা দিয়া যেই পার হইতেছে কেমন যেন দীর্ঘ সময় ধরিয়া তাহার প্রতি চাহিয়া দেখিতেছে , মন্দাকিনী ইহা লক্ষ্য করিয়া মন মধ্যে দগ্ধ হইতেছে । এমন সময় কোথা হইতে মধুমিতা আসিয়া বলিল ," জানিস মন্দা গোটা গ্রামে তোর নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে।" মন্দাকিনী শুনিল , কোনো উত্তর না করিয়া পাষাণের ন্যায় বসিয়া রহিল। নিশ্চুপ মন্দাকিনীকে দেখিয়া মধুমিতা কি ভাবিল তাহা আমার অজ্ঞাত সে দ্বিতীয় বাক্যটি আর ব্যায় না করিয়া চলিয়া গেল। মন্দাকিনী গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিয়া পালঙ্কে শুইয়া মুখটি উপাধাণে গুঁজিয়া হাউ হাউ করিয়া কাঁদিতে লাগিল। তাহার কানে মধুমিতার বলা কথাগুলো বারংবার বাজিতে লাগিল। সে নিজেকে কিছুটা সামলাইয়া লইয়া অমলেশকে ফোন করিল " অমলেশ আমি আর এখানে থাকতে পারবো না,  সবার মুখে মুখে আমার বদনাম ঘুরছে।" অমলেশ শুনিয়া মনে মনে প্রফুল্ল্য হইল , সে তো ইহাই চাহিয়াছিল তাহা না হইলে মন্দাকিনীর মতো একটি সুন্দরীকে লাভ করা তাহার মতো বেকার যুবকের স্বপ্নই রহিয়া যাইত , বিশেষত উচ্চবর্ণের সুন্দরীতো কদাপি নহে। সে মুখে বলিল ," তাহলে আর কি করা যাবে , তুমি চলে এসো বিয়ে করবো ।" মুখে এমন একটি ভাব দেখাইল যেন মন্দাকিনীর একটি বিরাট উপকার করিতেছে। মন্দাকিনী তাহার কর্ম সম্পর্কে জানিতে চাহিল , এ স্থলে অমলেশ একটি মিথ্যার আশ্রয় লইয়া বলিল ," আমি একটি বড় কোম্পানিতে চাকরি করি।" আর বিলম্ব না করিয়া পরের দিন খুব ভোরে গ্রামের লোক ঘুম হইতে জাগিবার পূর্বেই মন্দাকিনী আপন পিতা মাতার আশ্রয় ত্যাগ করিয়া বাহির হইয়া গেল। 
            প্রভাতে আপন গৃহের আঙিনায় মন্দাকিনীকে দেখিয়া অমলেশের হৃদয় পুলকিত হইয়া উঠিল , সে বলিল," চলো মন্দাকিনী আমরা বিয়ে করি।" মন্দাকিনী নিশ্চুপ দাড়াইয়া রহিল।অমলেশের মা বলিলেন," এই মেয়ে এসেই যখন গেছিস চল ঘরে চল।" মন্দাকিনী অমলেশের মাতার হাত ধরিয়া ঘরে ঢুকিল।
                  দুইদিন ধরিয়া মন্দাকিনী বিস্তর ভাবিল , সে জানিতে পারিল অমলেশ কোনো কোম্পানিতে কোনোপ্রকার কর্ম করেনা ; সে তাহার নিকট মিথ্যা বলিয়াছে। একবার ভাবিল ফিরিয়া যাই কিন্তু পরক্ষনেই মনে হইল ফিরিয়া গিয়া কি লাভ সকলে জানিয়া গিয়াছে , কিরূপে মুখ দেখাইব। আপন ভাগ্যকে দোষারোপ করিয়া দুচোখে নোনা জল লইয়া সে বধূর সাজে সজ্জিতা হইল। অনাড়ম্বরে তাহার বিবাহ সম্পন্ন হইয়া গেল , যাহা সে স্বপ্নেও কল্পনা করে নাই তাহাই আজ ঘটিয়া গেল। ভাগ্য যখন বিপথে চলিতে চায় তাহা বোধ করি রোধ করা যায় না কোনরূপ সুমতির তখন উদয় হয় না। ইহাই বুঝি নিয়তির খেলা ।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 


                    শুভ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করিয়া ফিরিয়া আসিয়া মন্দাকিনীর গ্রামে গেল তাহার খবর লইতে কিন্তু তথায় যাহা শুনিল তাহাতে শুভ্র-র মস্তিষ্কের শিরায় উপশিরায় যন্ত্রণার একটি অদৃশ্য স্রোত বহিয়া গেল। বারংবার তাহার কানে বাজিতে লাগিল ," মন্দাকিনী তো নিচু বর্ণের ছেলের সাথে চলে গেছে।" যদিও বর্ণভেদ প্রথা পূর্বের ন্যায় প্রকট নাই তথাপি এইক্ষেত্রে ইহাই সমালোচনার উপাদেয় উপাদান হইয়া একটি মুখরোচক পরনিন্দার পথকে প্রশস্থ করিয়া দেয়। মন্দাকিনীর  ক্ষেত্রে তাহার ব্যতিক্রম ঘটে নাই। শুভ্র আর স্থির রহিতে না পারিয়া আপন গৃহে ফিরিয়া আসিল। ঈশ্বর হয়তো মন্দাকিনীকে তাহার জন্য এই জগতে পাঠান নাই তাই সে তাহাকে পাইল না এই রূপ একটি তত্ত্ব মন মধ্যে প্রতিস্ঠিত করিল। আবার ভাবিল ভালোবাসার মানুষের সুখ দেখিয়া যদি হৃদয়ে ক্রোধের উদ্রেক হয় তাহা হইলে তাহা কখনোই ভালোবাসা হইতে পারে না , ত্যাগের মধ্যেই সে তাহার ভালোবাসার প্রাপ্তি স্বীকার করিয়া আপন হৃদয়কে বুঝাইতে চেষ্টা করিল। মনমধ্যে মন্দাকিনীর একটি চিত্র অঙ্কন করিয়া অভিনয়ের মুখোশ পরিয়া সে জন প্লাবনে মিশিয়া গেল। দুই কি তিন মাস পর একটি সরকারী চাকুরীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া চাকুরীতে যোগদান করিল।

             দীর্ঘ দশ বৎসর অতিক্রান্ত হইয়াছে। শুভ্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া সংসার জীবনে পদার্পণ করিয়াছে। তাহার একটি পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করিয়াছে। শুভ্র তাহার প্রিয় নামটির লিঙ্গ পরিবর্তন করিয়া তাহার সন্তানের নাম রাখিয়াছে মন্দাক। ভালোবাসাকে অনেক ভাবেই নিজের নিকট রাখা যায় , শুভ্র তাহার সন্তানের নামের মধ্যেই তাহার ভালোবাসাকে নিজের নিকট রাখিয়াছে । 
          একদিন কোনো একটি কাজে শুভ্র বর্ধমান গিয়া ফিরিবার পথে একটি শপিং কমপ্লেক্স দেখিয়া ভাবিল কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনিয়া লইবে। শপিং কমপ্লেক্স-এ ঢুকিয়া সে হতচকিত হইয়া গেল , এ কি ! সে কি দেখিতেছে ! এ তো মন্দাকিনী , তাহার রূপ লাবণ্য কোথায় যেন বিলীন হইয়া গিয়াছে , চোখের নীচে বলি রেখা মুখ শীর্ণ ; এইসব দেখিয়া শুভ্র বুঝিল মন্দাকিনীর উপর দিয়া হয়তোবা একটি দুশ্চিন্তার ঝড় বহিয়া গিয়াছে। সে তাহার নিকটে আসিয়া বলিল," মন্দাকিনী আমাকে চিনতে পারছো? তোমার এ কি অবস্থা!  তুমি এখানে!" আজ মন্দাকিনী রাগ দেখাইয়া শুভ্রকে তাড়াইয়া দিল না,  তাহার দিক হইতে মুখও ফিরাইয়া লইল না, সে বলিতে আরম্ভ করিল ," জানো শুভ্র সেদিন আমি বিরাট ভূল করেছি তার সাজা হয়তো পাচ্ছি এভাবেই। তোমাকে ওইভাবে তাড়ানোর পরও তুমি আমার খবর নিচ্ছ , জানতো এইভাবে এর আগে কেউ জিজ্ঞেস করেনি। আমি যাকে বিয়ে করেছি সে সংসার বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন। রোজগার যে করে না তা নয় কিন্তু যেটুকু রোজগার করে তাতে নুন কিনতে পান্তা ফুরোয় , সবদিন কাজেও যেতে চায় না। আমার একটা ছেলে আছে তাকে তো লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে হবে। জানো শুভ্র এখানে দশ ঘন্টা কাজ করি তারপর বাড়ী গিয়ে সব কাজ করতে হয় , খুব কষ্ট হয় খুব ! তবুও তো ছেলেটাকে মানুষ করতে হবে।" মন্দাকিনীর কঠোর পরিশ্রমে ভরা দুর্দশাগ্রস্ত জীবন কাহিনী শুনিয়া শুভ্র-র চোখে জল আসিল , সেটা মন্দাকিনীর চোখে পড়িতেই সে বলিল ," তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো শুভ্র!" শুভ্র কোনো উত্তর করিল না। মন্দাকিনী বলিল ," ছাড়ো আমার কথা , তোমার কথা বলো। বিয়ে করেছো? ছেলে মেয়ে কিছু ?" শুভ্র চোখের জল রুমালে মুছিয়া বলিল," হ্যাঁ বিয়ে করেছি, একটি ছেলেও আছে ।" 
" কি নাম দিয়েছো ছেলের ?"
" মন্দাক।"
শুভ্র-র মুখ হইতে তাহার ছেলের নাম শুনিয়া মন্দাকিনীর মাথাটা ছ্যাৎ করিয়া উঠিল । তাহার মনে হইল বুকের ভিতর হাজারটা হাতুড়ির ঘা পড়িতেছে। ভাবিল , যে মানুষটাকে একদিন আমি রাগ দেখাইয়া দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিয়াছি সেই মানুষটা আমাকে এতো ভালোবাসে যে আমার নামটা আঁকড়ে আজো বেঁচে আছে ।" মন্দাকিনীর দুচোখ অশ্রুসিক্ত হইল। " আজ তাহলে আসি মন্দাকিনী , পরে যদি আবার কোনোদিন দেখা হয় কথা হবে ," বলিয়া শুভ্র শপিং কমপ্লেক্স হইতে বাহির হইয়া গেল। সে যে কিছু কিনিতে আসিয়াছিল তাহা বেমালুম ভুলিয়া গেল। শুভ্র চলিয়া গেল। তাহার পথ পানে চাহিয়া চোখের জল মুছিতে মুছিতে মন্দাকিনী অস্ফুটে বলিল ," আমি তোমাকে ভালোবাসি শুভ্র! আমি তোমাকে ভালোবাসি! " কিছুক্ষণ পর শপিং কমপ্লেক্স হইতে বাহির হইয়া মন্দাকিনী দেখিল আকাশের বুকে জমা হওয়া কালো মেঘটা ভাঙিয়া চৌচির হইয়া বৃষ্টির আকারে ঝরিয়া পড়িতেছে।

** গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। যদি কাকতালীয় ভাবে কাহারো জীবনের সহিত মিলিয়া যায় তাহা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত। নিজ গুণে ক্ষমা করিবেন।
                                        
                                          ------- চিন্ময় মহান্তী 

------------------------------ সমাপ্ত------------------------

-
Previous
Next Post »

এই ব্লগটি সন্ধান করুন